পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনাটি ঘটে যেভাবে।।

দিনটা ছিলো ১৯৭৭ সালের ২৭ শে মার্চ।ঘড়ির কাটায় সময় বিকাল ৫ টা বেজে ৬ মিনিট।

এই সময়টাতে স্পেনের তেরেনিফে দ্বীপের লোস রোদেওস বিমানবন্দরে ঘটে যায় ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনাটি।রানওয়েতে দুটি বোয়িং ৭৪৭ বিমানের মুখোমুখি সংঘর্ষে মারা যায় ৫৮৩ জন যাত্রী।

তবে কেন আর কিভাবে ঘটেছিলো এই ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি?

সেটাই আজ জানার চেষ্টা করবো আমরা।

ঘটনার পটভূমি:

বিমান দুইটির মধ্যে একটি ছিলো নেদারল্যান্ডেস এর রয়েল ডাচ এয়ারলাইন্সের কেএলএম বোয়িং ৭৪৭।বিমানটির যাত্রী সংখ্যা ছিলো ৫৩ জন শিশুসহ ২৩৪ জন।

অপরটি ছিলো প্যান এম এর বোয়িং ৭৪৭,যাতে ৩৮০ জন যাত্রী ছিলো।

বিমান দুটির মূল গন্তব্য ছিলো স্পেনের গ্রান্ড কানেরিয়া দ্বীপের গান্দো বিমানবন্দর।তবে সেসময়ে দ্বীপটিতে চলছিলো স্বাধীনতা আন্দোলন।

দূর্ঘটনার দিনে বিমানবন্দরে সন্ত্রাসী হামলা হয়,বোমা বিস্ফোরণের ফলে ১ জন আহত হয়।

নিরাপত্তা বাহিনীরা আরো বোমা থাকার আশঙ্কা করায় বিমানবন্দরটিতে সকল যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়।

যেসব বিমান সেখানে অবতরণের কথা ছিলো সেগুলো নিকটবর্তী তেরেনিফে বিমানবন্দরে নামতে বলা হয়।

তেরেনিফে বিমানবন্দরের সক্ষমতা কেমন ছিলো?

তেরেনিফের রোস রোদেওস ছিলো খুব ছোট একটি বিমানবন্দর,যেখান থেকে কিছু আঞ্চলিক ফ্লাইট চালানো হতো।

দিনটি ছিলো রবিবার,ছুটির দিন।তাছাড়া ফ্লাইট সংখ্যা কম থাকায় কন্ট্রোল টাওয়ারে লোক ছিলো মাত্র ২ জন।

তাই গান্দো বিমানবন্দরের বিমানগুলো যখন এখানে অবতরন করতে থাকে তখন বিমানবন্দরটিতে প্রায় ট্রাফিক জ্যাম লেগে যায়।


বিকালের দিকে সব ফ্লাইটের জন্য গান্দো বিমানবন্দর খুলে দেওয়া হয়।তাই তেরেনিফে থেকে সব বিমান গান্দো বিমানবন্দরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে।

ফলে তেরেনিফে বিমানবন্দরে বিমান উড্ডয়নে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।

তবে কেএলএম এর ক্যাপ্টেন জেকভ বানজান্টন ঐদিন একটু বেশীই তাড়াহুড়া করছিলো।

কেএলএম বিমানের ক্যাপ্টেন উড্ডয়নের জন্য তাড়াহুড়া করছিলো কেন?

১৯৭৪ সালে নেদারল্যান্ডসের সরকার বিমান ফ্লাইটের বিষয়ে একটি কঠোর নিয়ম আরোপ করেছিলো।কেউ তার ফ্লাইট ডিউটি সীমা অতিক্রম করলে তাকে জরিমানার সম্মুখীন হতে হতো।
এমনকি তার লাইসেন্সও বাতিল হতে পারতো অথবা কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হতো।

বানজান্টনের সেদিনকার অনুমোদিত উড্ডয়ন ঘন্টা শেষ হতে আর বেশী দেরি ছিলোনা।ফলে তিনি ফ্লাইট পরিচালনায় দেরী করলে শাস্তির সম্মুখীন হতে পারতো।

তাছাড়া সে যদি ফ্লাইট পরিচালনা না করতেন তাহলে রয়েল ডাচ এয়ারলাইনসকে ক্রু ও যাত্রীদের থাকা-খাওয়া,নতুন ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতির খরচসহ মোটা অংকের টাকা গুনতে হতো।

ক্যাপ্টেন বানজান্টন বিমানে অতিরিক্ত তেল মজুদ করেছিলেন কেন?

গান্দো বিমানবন্দরটি খুলে দেওয়ার পর পর্যায়ক্রমে সব বিমান অবতরন করতে থাকে।সিরিয়াল অনুযায়ী অবতরণের ক্ষেত্রে রানওয়েতে কেএলএম এর পর প্যান অ্যাম বিমানের অবস্থান ছিলো।

তবে সময় বাঁচাতে কেএলএম এর ক্যাপ্টেন বানজান্টন লোস রোদেওস থেকে বিমানে আমস্টারডাম যাওয়ার জন্য ৫৫ টন তেল নিয়ে নেন,যা গান্দো বিমানবন্দরে অবতরণের জন্য অতিরিক্ত ছিলো।

এয়ারলাইনসের ক্ষেত্রে কোনো বিমানবন্দরে অবতরণের জন্য সেখানকার জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত তেল নেওয়া নীতিবিরুদ্ধ।
কারন এতে বিমান অনেক ভারী হয়ে যায়।ফলে কোনো বিমানবন্দরে অবতরণের সময় তা ভেঙে পড়তে পারে।

এই তেল নিতে গিয়ে বানজান্টন রানওয়েতে প্যান অ্যাম বিমানের পথ ৪০ মিনিট অবরোধ করে রাখেন।

আর ঠিক সেই সময়ে নিকটবর্তী পাহাড় থেকে ঘন কুয়াশা নেমে আসে।এই ঘন কুয়াশার মধ্যেই উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিতে থাকে বিমান দুইটি।

কন্ট্রোল টাওয়ার বিমান দুটিকে কি নির্দেশনা দিয়েছিলো?

কন্ট্রোল টাওয়ারের নির্দেশনা ছিলো কেএলএম উড্ডয়নের পর প্যান অ্যাম উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিবে।
মূল রানওয়েতে ওঠার পর প্যান অ্যাম সি৩(রানওয়ের একটি গেটওয়ে) গেট দিয়ে বামে ঘুরে যাবে আর কেএলএম রানওয়ের শেষ মাথায় গিয়ে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে সোজা উড্ডয়ন করবে।

দুর্ঘটনাটি যেভাবে ঘটেছিলো:

ঘন কুয়াশার প্রভাবে চারিদিক অন্ধকার হওয়ায় রানওয়েতে বিমানের দৃষ্টিসীমা ৫০০ মিটারে নেমে আসে,যা অন্তত ৭০০ মিটার থাকার কথা।

ফলে প্যান অ্যামের ক্যাপ্টেন সি৩ গেট দেখতে না পেয়ে কিচুটা বিচলিত হয়ে রানওয়ের পূর্বের জায়গাতেই অবস্থান করেন।

এদিকে কেএলএমের ক্যাপ্টেন বানজান্টন বিমানের কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে ক্লিয়ারেন্স না নিয়েই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে বিমানের ইঞ্জিন চালু করে দেন।এতে উড্ডয়ন গতিসীমায় পৌছানোর জন্য ইঞ্জিন বিপুল গতিতে ঘুরতে থাকে।

তখন তার সহকারি তাকে মনে করিয়ে দেয় যে,তিনি তাড়াহুড়োর জন্য কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে ক্লিয়ারেন্স নিতে ভুলে গেছে।বানজান্টন তখন তার সহকারিকে কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে নিতে বলেন।

কো-পাইলট অস্পষ্টভাবে কন্ট্রোল টাওয়ারকে বলেন,”উই আর নাও টেকিং অফ”।এটাকে কন্ট্রোল টাওয়ার ভেবে নেয় যে,”আমরা উড্ডয়নের জন্য প্রস্তুত আছি”।

কন্ট্রোল টাওয়ার প্রাথমিকভাবে বুঝতে না পারায় বলে “ওকে”।কিন্তু এটা মূলত ক্লিয়ারেন্স ছিলোনা।
কিন্তু এই “ওকে” শুনেই কো-পাইলট বলে ওঠেন “উই আর গোয়িং” মানে আমরা যাত্রা শুরু করছি।
কিন্তু তৎক্ষণাৎ প্যান অ্যামের ক্যাপ্টেন কন্ট্রোল টাওয়ারকে জানায় যে,তারা এখনও রানওয়েতেই রয়ে গেছেন।

তাই, সাথে সাথেই কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে বলে ওঠে “স্ট্যান্ডবাই ফর টেকঅফ” অর্থাৎ উড্ডয়নের জন্য অপেক্ষা করুন।

তবে একমুখী বেতার ব্যবস্থার কারনে কেএলএম এর ক্যাপ্টেন বিষয়টি স্পষ্টভাবে শুনতে পারেনি।

কারণ কন্ট্রোল টাওয়ার আর প্যান অ্যাম এর ক্যাপ্টেন একই সাথে কেএলএম এর পাইলটকে বেতারে সতর্ক করতে গিয়েছিলো।

তবে স্পষ্ট নির্দেশনার অপেক্ষা না করে কেএলএম এর ক্যাপ্টেন বানজান্টন রানওয়েতে বিমান চালনা করতে থাকেন।কিন্তু শেষ মুহুর্তে এসে রানওয়েতে প্যান অ্যাম বিমানটি বানজান্টনের দৃষ্টিগোচর হয়।

প্যান অ্যাম এর ক্যাপ্টেন রানওয়ে থেকে সরে যাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করেন।তবে তা কাজে আসেনি।
এদিকে বানজান্টন প্যান অ্যামকে দেখামাত্রই কেএলএমকে উড্ডয়ন করার চেষ্টা করেন।খানিকটা সফলও হন।

তবে অতিরিক্ত জ্বালানি থাকার ফলে বিমানটি ভারী হওয়ার ফলে উড়তে প্রত্যাশিত সময়ের চেয়ে বেশী সময় লাগে।ফরে কেএলএম এর লেজের অংশ প্যান অ্যামের উপর আছড়ে পড়ে।

ফলে এই দুর্ঘটনায় কেএলএম এর সকল যাত্রী ও প্যান অ্যামের প্রায় ৮০ ভাগ যাত্রীই নিহত হয়।

দুর্ঘটনার কারণ:

স্প্যানিশ তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে জানা যায়,কেএলএমের পাইলট কন্ট্রোল টাওয়ারের নির্দেশনা ঠিকভাবে বুঝতে পারেননি।ফলে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।মূলত এতেই দুর্ঘটনা ঘটে।

এছাড়া প্রতিকূল আবহাওয়া সাথে স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত বিমানের উঠানামাও এ দুর্ঘটনার জন্য একটা প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।

সেইসাথে বিমানের তৎকালীন একমুখী বেতার ব্যবস্থার কারণে পরবর্তীতে পাইলটকে সতর্ক করাও সম্ভব হয়নি।ফলে এতো ব্যপক প্রাণহানি ঘটে।

তবে ঘটনাটি ইতিহাসে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।এই দুর্ঘটনার পর বিমান চলাচলে বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন এনে একটি প্রমিত মান দাঁড় করানো হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top