উপনিবেশ বা “কলোনি” শব্দটি ল্যাটিন “কলোনিয়া” থেকে উদ্ভুত।
উপনিবেশ কি?
উপনিবেশ বা কলোনি বলতে এমন একটি স্থান বা এলাকাকে বোঝায় যা অন্য কোনো দেশ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়।
যখন একটি দেশের একাধিক কলোনি থাকে,তখন মূল দেশটিকে সাম্রাজ্য হিসেবে অভিহিত করা হয়।
উপনিবেশে অবশ্যই অনেক লোকসংখ্যা থাকতে হবে এবং যেদেশ উপনিবেশ গঠন করে তাকে সেই অঞ্চল ও জনগণের দায়ভার নিতে হবে।একসময় বিশ্বে বহু উপনিবেশ ছিলো,যারা বর্তমানে স্বাধীন দেশে রুপান্তরিত হয়েছে।তবে বর্তমানেও কিছু উপনিবেশের অস্তিত্ব আছে।যেমনঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুয়োর্তো রিকো,ফ্রান্সের ক্যালিডোনিয়া,ভার্জিন আইল্যান্ড,সেইন্ট মার্টিন,ব্রিটিশদের জীব্রাল্টার,ফকল্যান্ড ইত্যাদি।
যে দেশগুলো কখনই উপনিবেশ ছিলনাঃ
পূর্বে অধিকাংশ উপনিবেশ দেশই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো।উপনিবেশ অঞ্চলের কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার নেই এবং এর প্রশাসন ব্যবস্থা উপনিবেশ বা কলোনি গঠন করা দেশ সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে।
তবে এমনও কিছু সৌভাগ্যবান দেশ আছে,যারা কখনও কোনো দেশের উপনিবেশ ছিলোনা।দেশগুলো হলঃ
১.লাইবেরিয়া
২.ইথিওপিয়া
৩.থাইল্যান্ড
৪.নেপাল
৫.ভুটান
৬.টোঙ্গা
৭.চীন
৮.জাপান
৯.মঙ্গোলিয়া
১০.ইরান
দেশগুলোর উপনিবেশ না হওয়ার কারণ বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়ায় এটি দুইটি পর্বে প্রকাশ করা হলো।
আজ পর্ব-২ এ টোঙ্গা,চীন,ইরান,জাপান ও মঙ্গোলিয়া নিয়ে আলোচনা করা হবে।
৬.টোঙ্গা
টোঙ্গা ও ব্রিটেনের সন্ধির ফলে ব্রিটেন টোঙ্গার রক্ষক হয়ে ওঠে।টোঙ্গা সমস্ত বিদেশি বিষয়ে কূটনীতিক প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার ব্রিটেনকে প্রদান করে।ফলে টোঙ্গা সাম্রাজ্যবাদীদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়।
কিন্তু এটাকে উপনিবেশ হিসেবে দেখা হয়না।কেননা ব্রিটিশদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের পর টোঙ্গার রাজতন্ত্র বাতিল করা হয়নি,স্থানীয় আদালত ও প্রতিষ্ঠানগুলো ব্রিটিশ রীতি অনুযায়ী প্রতিস্থাপন বা পরিচালিত হয়নি।বাইরের কোনো গভর্নর দিয়েও দেশ পরিচালিত করা হয়নি।মূলত টোঙ্গা ছিলো ব্রিটেনের আশ্রিত রাষ্ট্র। ১৯৭০ সালে এটি স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
৭.চীনঃ
যুদ্ধের ময়দানে দুইটা প্রবাদ রয়েছে।
১. শীতকালে কখনও রাশিয়া আক্রমণ করবেনা
২. পুরো চীন কখনও দখল করবেনা
তবে চীন বহিরাগত মঙ্গোলীয় ও মাঞ্চুদের দ্বারা বারবার আক্রমিত হয়েছে।তবে তারা উপনিবেশ গঠনের পরিবর্তে চীনাদের ভাষা ও সাংস্কৃতির সাথে মিশে গেছে এবং চীনাদেরই অংশ হয়ে গেছে।
চীন পূর্ব থেকেই বৃহৎ রাষ্ট্র।এতোবড় রাষ্ট্রকে কেউ দখল করা ও কলোনি প্রতিষ্ঠা করাকে ঔপনিবেশিক শাসকেরা অর্থহীন মনে করেছে।তার বদলে তারা চাপ প্রয়োগ করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের প্রচেষ্টা করেছে।
চীনে প্রচুর চা উৎপাদন হতো।ব্রিটিশরা অনেক চা পছন্দ করতো।ফলে তারা চীন থেকে টন টন চা আমদানি করে ভারতবর্ষ ও অন্যান্য ইউরোপের দেশগুলোতে পাঠাতো।সাথে তারা চীন থেকে রেশমও আমদানি করতো।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে চীনা চায়ের চাহিদা আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেলো।
চীনারা এ পণ্যগুলো শুধুমাত্র সোনা আর রুপার বিনিময়ে রপ্তানি করতো।কেননা তারা প্রাচীনকাল থেকেই প্রায় সব পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলো।ফলে বানিজ্যের জন্য ব্রিটিশদের ব্যপক সোনা-রূপা ব্যয় করতে হতো।
এ অবস্থা উত্তরণের জন্য ব্রিটিশরা কূটকৌশলের আশ্রয় নিতে থাকে।কিভাবে চীনকে তাদের থেকেও পণ্য কিনতে বাধ্য করা যায় তা ভাবতে থাকে।
অবশেষে তারা একটি উপায় খুঁজে পায়।
তারা ইউরোপের নিষিদ্ধ মাদক আফিম ভারতে চাষ করে তা চীনে পাঠানো শুরু করে।এমনকি শোনা যায়,তারা প্রথম প্রথম চীনে ফ্রিতে আফিম সরবারহ করতো।এভাবে ধীরে ধীরে চীনারা আফিমে গ্রাস হলে তারা অর্থের বিনিময়ে এগুলো বেঁচতে শুরু করে।ফলে ব্রিটিশরা তাদের কূটকৌশলে জয়ী হয় ও ব্যপক লাভ করতে থাকে।
ফলে চীনে ব্যপকভাবে সামাজিক সমস্যা ও দারিদ্র্য বাড়তে থাকে।চীনের কিং রাজা দেশের এই করুণ পরিণতি দেখে চীনে আফিম নিষিদ্ধ করে এবং ১৮৩০ সালে আফিমের দোকান ও গুদামগুলো বাজেয়াপ্ত করে।এতে ব্রিটিশদের অর্থনীতিতে আঘাত আসে।ব্রিটিশরা অভিযান বন্ধ করতে অনুরোধ করলেও রাজা তাতে অস্বীকৃতি জানান।
১৮৩৯ সালে ব্রিটেন চীনের রাজার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে যা আফিম যুদ্ধ নামে পরিচিত।
১৮৪২ সাল পর্যন্ত চলা এ যুদ্ধে চীন পরাজিত হয়।ফলে ব্রিটিশদের সাথে নানকিং চুক্তি করতে বাধ্য হয়।এই চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশরা ব্যপক লাভবান হয়।ফলে চীনকে হংকং হারাতে হয়।ব্রিটিশরা ব্যবসার জন্য চীনের ৫ টি বন্দর ব্যবহারের অনুমতি পায় এবং চীনে অবস্থানরত ব্রিটিশরা কোনো অপরাধ করলে তার বিচারিক ক্ষমতা ব্রিটেনের হাতে ন্যস্ত হয়।এছাড়া চীনাদের ব্যবসায়ের শুল্ক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাও সীমাবদ্ধ করা হয়।যুদ্ধের জন্য ব্রিটিশদের ২১ মিলিয়ন সিলভার ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়।
এই চুক্তির সুযোগ নিয়েছিলো অন্যান্য দেশগুলোও।ফলে যুক্তরাষ্ট্র ওয়াংশিয়া চুক্তি,ফরাসীরা হোয়াম্পেয়ার চুক্তি করে চীনকে পুরোপুরো অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে ফেলে।
চীনাদের স্বাধীনতা থাকলেও তারা অর্থনৈতিকভাবে ব্যপক দূর্বল হয়ে পড়ে।
৮.ইরান
ভৌগলিক ও ভূরাজনৈতিক দুইদিক থেকেই ইরান সুবিধাজনক স্থানে ছিলো।তাই কার্যতভাবে অন্য দেশের কলোনিতে পরিণত হয়নি।এর মানচিত্রের পশ্চিমে জাগ্রোস পর্বতমালা,উত্তরে মাউন্ট এলব্রুজ,পূর্বে ছোট পর্বতশ্রেণী আর দক্ষিণে পারস্য উপসাগর হওয়ায় এটি ভৌগলিকভাবে সুরক্ষিত ছিলো।
তবে তারা ব্রিটিশ-সোভিয়েভ প্রভাব বলয়ের মধ্যে ছিলো।এজন্য অন্যান্য পশ্চিমা দেশও তাদেরকে কলোনি করার আগ্রহ দেখায়নি।
ইরানের রাজারা পশ্চিমাদের সাথে বিভিন্ন চুক্তি করে তাদেরকে অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিলো।এজন্য তাদেরকে আর ইরান জয় করার প্রয়োজন হয়নি।
সাফাভিদ রাজবংশের পর ইরানের ক্ষমতায় আসে কাজার রাজবংশ।কাজারের নাসের শাহ সোভিয়েত-ব্রিটিশ উপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দীতা দেখে পারস্যকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্ররুপে বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন।
ইরানের দক্ষিণ ও পূর্ব অংশ ছিলো ব্রিটিশদের প্রভাব বলয়ের অধীনে,আর আধুনিক আজারবাইজান ও তুর্কেমেনিস্তানের নিকটবর্তী উত্তর অংশটি ছিলো সোভিয়েত প্রভাবের অধীনে। বেশীরভাগ কাজার নীতি ছিলো ব্রিটিশদের উপকারের জন্য।ফলে তখনকার সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের পুতুলরাষ্ট্র ইরানকে কলোনি করার প্রয়োজন মনে করেনি।ব্রিটিশরা তাদের স্বার্থ রক্ষায় ইরানের সাথে “অ্যাংলো-পার্সিয়ান তেল কোম্পানি(এপোক)” নামক পেট্রোলিয়াম কোম্পানি গঠন করে,যার লাভের সিংহভাগই ব্রিটিশরা নিয়ে যেতো।তাবারিজ,কাজান শহরের উপর সোভিয়েত প্রভাব থাকায় তারা সেখান থেকে তেল উত্তোলন করে নিতো।
ইরানের শাহ রাজারা এতোটাই অযোগ্য ছিলো যে তাদেরকে আর উপনিবেশ করার প্রয়োজন পড়েনি।বরং এদের সাথে বিভিন্ন চুক্তি করাটাই বেশী সুবিধাজনক ছিলো।
১৯৫৩ সালে ইরানে পশ্চিমা মদদপুষ্ট সৈন্যদের অভ্যুত্থানের দ্বারা আহমেদ শাহ পাহলভীকে ক্ষমতায় আনে।১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সংগঠিত হয়।
৯.জাপানঃ
জাপান ইউরোপ থেকে অনেক দূরে ও বিশ্বের এককোণে অবস্থিত।জাপানের রাজারা তুলনামূলক শক্তিশালী ছিলো।
তবে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে জাপান পর্তুগীজদের কবলে পড়েছিলো।পর্তুগীজরা বুঝেছিলো জাপানকে উপনিবেশ করতে গেলে অধিবাসীদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার বিকল্প নাই।তাই তারা ব্যপকভাবে ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্ম প্রচার শুরু করে।ফলে অনেকেই খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়।তারা সর্বপ্রথম জাপানে বন্দুকের নতুন নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আসে।কিন্তু জাপানের রাজারা পর্তুগীজদের ক্রমবর্ধমান ক্যাথলিক ধর্মকে দীক্ষিত করাকে তাদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছিলো।সামুরাই সম্রাট টোডুগা শেগুনেট শেষ পর্যন্ত ১৬১৩ সালে দেশব্যপী খ্রিস্টধর্ম নিষিদ্ধ করেছিলো ও তাদের অনুসারীদের উপর নির্যাতন শুরু করেছিলো।
তারা বিদেশীদের জন্য ক্লোজডোর নীতি প্রবর্তন করে।জাপানীদের বিদেশভ্রমণ ও বিদেশীদের সাথে যোগাযোগ নিষিদ্ধ করেছিলো।ফলে বিদেশী বানিজ্যের উপর সরকার একচেটিয়া অধিকার পায়।
জাপান শুধুমাত্র ডাচদের ব্যবসার অনুমতি দিয়েছিলো।ডাচরা কিউশুর নাগাসাকি বন্দর দিয়ে শুধুমাত্র বানিজ্য করতে পারতো।তবুও ডাচদের মাধ্যমে জাপানীরা চিকিৎসা,উদ্ভিদবিজ্ঞান,জ্যোতির্বিজ্ঞান,ভুগোলের মতো ইউরোপীয় জ্ঞানে দীক্ষিত হয়েছিলো।
আঠারশো শতাব্দীর শেষ অবধি উপনিবেশিক শক্তিগুলো সাকোকু(ক্লোজডোর) নীতিকে চ্যালেঞ্জ জানাইনি।উনিশ শতকের প্রথমে রাশিয়া,তারপর ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র এই নীতিকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে জাপান ১৮৫৪ সালে জাপান একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত করে।ফলে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য শিমোদা,হাকোডার বন্দর খুলে দেয়।পরবর্তীতে ব্রিটেন,রাশিয়া,নেদারল্যান্ড,ফ্রান্সের সাথেও একই চুক্তি স্বাক্ষর করে তারা।ফলে ইয়োকোহামা,নাগাসাকি,নিগোটা,কোবে বন্দরগুলোও উন্মুক্ত করা হয়।তারা জাপানে কনস্যুলেটও স্থাপন করে।ফলে জাপান কলোনাইজড না হলেও একটি অর্ধবৃত্তীয় রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জয়লাভ ও জাপানের পরাজয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এদের পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী বিদেশী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়,যার প্রভাব এখনও বিদ্যমান।
১০.মঙ্গোলিয়াঃ
মঙ্গোলিয়া পূর্ব থেকেই স্বাধীন রাষ্ট্র ছিলো।সাথে এর অদিবাসীদের যাযাবর জীবণ ও চরমভাবাপন্ন জলবায়ু এদেরকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে দূরে রেখেছিলো।
১২০৬ সালে চেঙ্গিস খান মঙ্গোলীয়দের একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিলো এবং তাদেরকে একটি যুদ্ধবাজ জাতিতে পরিণত করেছিলো।তৎকালীন সময়ে মোগল সাম্রাজ্য ছিলো ইতিহাসের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য।মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পর মঙ্গোলিয়ার কিছু অংশ চীনের কিং রাজাদের অধীনে চলে যায়।বাকি অংশ স্বাধীন থাকে।
মঙ্গোলিয়া দুইটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।একটি ইনার মঙ্গোলিয়া,অপরটি আউটার মঙ্গোলিয়া।
বর্তমান মঙ্গোলিয়ার ভৌগলিক অংশটি আউটার মঙ্গোলিয়ার অন্তর্গত।ইনার মঙ্গোলিয়ার অংশটি বর্তমানে চীনের অধীনে থাকা একটি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল।
১৯২১ সালে আউটার মঙ্গোলিয়া সোভিয়েত প্রভাব বলয়ের অধীনে আসে।ফলে সেখানে অন্য কোনো দেশ ঔপনিবেশীকরণে আগ্রহ দেখাইনি।ফলে মঙ্গোলিয়া সোভিয়েতের আশ্রিত রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন থাকে।