ডেড সি বা মৃতসাগরঃ বিস্ময়কর যে হ্রদে চাইলেও কেউ ডুবতে পারেনা।।

মৃত সাগর।নামটা পড়লেই মনে ধারণা জন্মে হয়তো পূর্বে সাগর ছিলো,এখন শুকিয়ে গেছে।অথবা কোনো মৃতপ্রায় সাগর। কিন্তু আসলেই কি তাই?

মৃত সাগর কি আসলেই সাগর?

আদতে মৃত সাগর কোনো সাগরই না,এটা একটা হ্রদ।
ভাবুন গড়ে ১২০ মিটার গভীর একটা হ্রদের পানির উপর দিয়ে আপনি সাঁতার না কেটেই ভেসে বেড়াচ্ছেন,মন চাইলে শুয়ে বা বসে বই পড়ছেন কিন্তু ডুবছেন না।এটা কি আসলেই সম্ভব।

হ্যা,মৃত সাগর বা “ডেড সি” র ক্ষেত্রে তা অবশ্যই সম্ভব।

স্যাটেলাইট ইমেজে মৃতসাগর


অবস্থানঃ

মৃত সাগর ফিলিস্তিন,জর্ডান আর ইসরাইলের অববাহিকায় অবস্থিত।এর পশ্চিমে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও ইসরায়েল এবং পূর্বে জর্ডান অবস্থিত।এটি জেরুজালেম থেকে মাত্র ২৪ কিমি দূরে অবস্থিত।

আয়তন ও গভীরতাঃ

মৃত সাগর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪২০ মিটার(১৩৭৮ ফুট) নিচে অবস্থিত।এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে নিম্নভূমি।
হ্রদটির আয়তন ৮১০ বর্গকিমি
।এর দৈর্ঘ্য ৬৭ কিমি এবং প্রস্থ ১৮ কিমি।গড় গভীরতা ১২০ মিটার(৩৯৪ ফুট),সর্বাধিক গভীরতা ৩৩০ মিটার(১০৮৩ ফুট)।হ্রদটির পানির আয়তন ১৪৭ ঘন কিমি।এটি প্রায় ১৩৫ কিমি উপকূলীয় এলাকা বেষ্টন করে রয়েছে।


কিভাবে সৃষ্টি হলোঃ

প্রায় ৩০ লক্ষ বছর আগে বর্তমান জর্ডান নদী,মৃত সাগর এবং ওয়াদী আরাবাহ অঞ্চল লোহিত সাগরের পানিতে বারবার প্লাবিত হতো।ফলে এ অঞ্চলে একটি সরু উপসাগরের সৃষ্টি হয়।তখন এ অঞ্চলটি একটি সরু সংযোগের মাধ্যমে লোহিত সাগরের সাথে সংযুক্ত ছিলো।
প্রায় ২০ লক্ষ বছর পূর্বে এই উপত্যকা ও লোহিত সাগরের মধ্যবর্তী স্থলভাগটি যথেষ্ট উচ্চতা লাভ করে।ফলে মহাসাগরের প্লাবনে সৃষ্ট উপসাগরটি পরিবেষ্টিত হয়ে হয়ে হ্রদে পরিণত হয়।

মৃত সাগরই কি বিশ্বের সবচেয়ে লবণাক্ত পানির উৎস?

মৃত সাগরের পানি অত্যন্ত লবণাক্ত।কিন্তু এটিই যে পৃথিবীর সবচেয়ে লবণাক্ত পানির হ্রদ তাও না।
ডন জুয়ান পন্ড(এন্টার্কটিকা),লেক রেতবা(সেনেগাল),লেক ভান্ডা(এন্টার্কটিকা),গারাবোগাজকোল(তুর্কমেনিস্তান),লেক আসাল(জিবুতি) এর পর এটি বিশ্বের ৬ষ্ঠ সর্বোচ্চ লবনাক্ত পানির হ্রদ।এর লবণাক্ততা শতকরা ৩৩.৭% এবং এর পানি সমুদ্রের পানির চেয়েও ৮.৬% বেশী লবনাক্ত

মৃত সাগরে বসে একজন বই পড়ছে


মৃতসাগরে কেউ ডোবেনা কেন?

মৃতসাগর” বা “ডেড সি” তে চাইলেই আপনি ডুবতে পারবেন না।আপনি চাইলে এর পানিতে দাঁড়িয়ে,বসে অথবা শুয়ে শুয়ে বই পড়েও যেতে পারবেন কিন্তু শুধু ডুববেন না।
এর মূল কারণ হল মৃত সাগরের পানির অতিরিক্ত লবণাক্ততা।পানিতে লবণের পরিমাণ অনেক বেশী হওয়ার কারণে এই পানির প্লবতাও বেশী।

প্লবতা কি?

প্লবতা হচ্ছে কোনো বস্তুর উপর পানির উর্ধ্বমুখী বল।কোনো বস্তুকে যখন পানিতে ডুবানো হয়,তখন বস্তুটি পানিতে একটা বল প্রয়োগ করে।অনুরূপভাবে পানিও বস্তুটির উপর একটি উর্ধ্বমুখী বল প্রয়োগ করে।যদি বস্তুটির বলের চেয়ে পানির উর্ধ্বমুখী বল বেশী হয় তাহলে বস্তুটি পানিতে ভেসে থাকে।মৃত সাগরের পানিতে লবণাক্ততা প্রায় ৩৩.৭% হওয়ায় এর পানির প্লবতাও বেশী।একারণে এখানে সব বস্তুই ভেসে থাকতে পারে।এর পানির ঘনত্ব প্রায় ১.২৪ কেজি/লিটার।এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহতে অবস্থিত “দ্যা গ্রেট সল্ট লেক” এও অনুরুপভাবে পানিতে ভেসে থাকা যায়।

মৃতসাগরের পানির খনিজ উপাদানঃ

বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে,মহাসাগরের পানির তুলনায় মৃতসাগরের পানিতে মিশে থাকা খনিজ উপাদানগুলোর পার্থক্য রয়েছে।মৃতসাগরের পানিতে মিশে থাকা লবণে ১৪% ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড,৪% পটাসিয়াম ক্লোরাইড,৫০% ম্যাগনেশিয়াম ক্লোরাইড এবং ৩০% সোডিয়াম ক্লোরাইড রয়েছে।

Source: Pixabay

মৃতসাগরকে স্বাস্থ্যকর এলাকা বলা হয় কেন?

মৃত সাগরের অঞ্চলটি বর্তমানে স্বাস্থ্যকর এলাকা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।হ্রদটির পানিতে খনিজ দ্রব্যাদির বিপুল উপস্থিতি,বাতাসে এলার্জি উৎপাদক দ্রব্য এবং পরাগরেণুর স্বল্পতা,উচ্চ ভূমণ্ডলীয় চাপ,সৌর বিকিরণে অতিবেগুনী রশ্মির উপস্থিতি কম,উচ্চ বায়ুমন্ডলীয় চাপের কারণে এ অঞ্চলটি শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকা রোগীদের জন্য বেশ উপকারী।এখনে অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অক্সিজেনের পরিমাণ প্রায় ১০% বেশী থাকে।
এছাড়া চর্মরোগ নিরাময়ে মৃতসাগরের কাদা বেশ উপকারী।এজন্য এখানে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদেরকে এই হ্রদের কাদা মেখে সমুদ্রে সূর্যস্নান করতে দেখা যায়।

মৃত সাগরে প্রাণীর অস্তিত্ব আছে কি?

অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে হ্রদে কোনো মাছ বাঁচতে পারেনা।এজন্য এখানে কোনো মাছ নেই,এমনকি কোনো জীবই এখানে বাঁচতে পারেনা।শুধুমাত্র কিছু ফাংগাস আর ব্যাকটেরিয়া এখনে জন্মে।তবে মৃতসাগর তীরবর্তী পাহাড় ও মরুভূমিতে উট,খরগোশ,খেঁকশিয়াল এমনকি চিতাবাঘ ও দেখতে পাওয়া যায়।পাহাড়ে পাম আর প্যাপিরাস গাছ দেখতে পাওয়া যায়।এছাড়া এই এলাকাটিতে প্রচুর খেঁজুর গাছ জন্মে।

মৃত সাগর

এটি নেগেভ মরুভূমির অভ্যন্তরে অবস্থিত হওয়ায় গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুব কম।বছরে গড়ে ৫০-৬৫ মিমি বৃষ্টিপাত হয় এখানে।এই এলাকার বার্ষিক বাষ্পায়নের হার ১৪০০ মিমি।এজন্য হ্রদ এলাকাটি কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে থাকে।
মৃতসাগর তীরবর্তী অঞ্চলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনবসতি রয়েছে।এরমধ্যে এইন গেদি,নেভে যোহার,মিজিলেট এলাকার কালইয়া,মিজপে,শালেম,আভনাতের ইসরায়েলী জনবসতিগুলো উল্লেখযোগ্য।

মৃত সাগরে লবণের স্তুপ

অর্থনৈতিক গুরুত্বঃ

অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মৃতসাগরের গুরুত্ব অপরিসীম।প্রাচীনকাল থেকেই এই এলাকাটি অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।মিশরীরয়া এই হ্রদটি থেকে ভাসমান পিচ সংগ্রহ করে তা দিয়ে মৃতদেহের মমি তৈরি করতো।এছাড়া লবণ ও খনিজদ্রব্যের ব্যপকতার জন্য জর্ডান ও ইসরায়েল মৃতসাগরের পাশে অনেকগুলো শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে।খাবার লবণ,ব্রাইন,পটাসিয়াম,ক্যালসিয়ামের প্রাকৃতিক আঁধার এই মৃতসাগর।এছাড়া এসব খনিজদ্রব্য দিয়ে নানা রকম প্রসাধনী সামগ্রীও তৈরি হয়।

মৃতসাগর কি ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে?

মৃতসাগর তিনদিক দিয়ে বেষ্টিত আর অপরদিক দিয়ে জর্ডান নদী ও অন্যান্য উৎস হতে পানি মৃতসাগরে প্রবাহিত হয়।ফলে মৃতসাগরের পানি বাইরে বেরোতে পারেনা।৭০০০০ বছর পূর্ব থেকে ১২০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত মৃতসাগরের পানির উচ্চতা বর্তমান উচ্চতার চাইতে ১০০-২৫০ মিটার উঁচু ছিলো।২৬০০০ বছর পূর্বে এর পানির স্তর সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছে। ১০০০০ বছর পূর্ব থেকে এর পানির উচ্চতা ক্রমশ কমতে থাকে এবং কয়েকহাজার বছর ধরে এটি মোটামুটি ৩৫০ মিটার এর আশেপাশে অবস্থান করছে।


তবে ক্রমেই ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে হ্রদটির পানির গভীরতা।হ্রদটি মরুভূমির মধ্যে হওয়ায় গরম আবহাওয়ার জন্য এমনিতেই প্রচুর পানি বাষ্পীভূত হয়।এছাড়া কলকারখানার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত খনিজদ্রব্যগুলো ব্যাপকভাবে উত্তোলনের ফলে ক্রমশ কমে যাচ্ছে মৃতসাগরের গভীরতা।

হ্রদটি বাঁচাতে গৃহিত পদক্ষেপঃ

১৯৩০ সাল থেকে বছরে গড়ে ০.৭-১ মিটার গভীরতা কমছে হ্রদটির।ফলে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে এর অস্তিত্ব।
এই পরিস্থিতি নিরসরে জর্ডান আর ইসরায়েল ২০১৫ সালে ৯০০ মিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে।চুক্তি অনুযায়ী দুইদেশের শিল্প-কারখানাগুলো মৃতসাগর থেকে অধিক পরিমাণে পানি উত্তোলন করবেনা এবং লোহিত সাগর আর মৃতসাগরের মধ্যে একটি খাল কেটে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি লোহিত সাগর থেকে মৃতসাগরে পাম্প করা হবে,যাতে এর পানির স্তর স্বাভাবিক থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top