আন্তঃমহাদেশীয় দেশ!! যেদেশগুলো একাধিক মহাদেশে অবস্থিত
ভাবতেই অবাক লাগে তাইনা!!বিষয়টা এমন যে,ধরুন সকালের নাস্তা করছেন এশিয়াতে আর বিকালে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ইউরোপ মহাদেশে।
Transcontinental Countries বা আন্তঃমহাদেশীয় দেশ কাকে বলে?এমন কতটি দেশ আছে?
আপনার জানার আগ্রহ থাকলে চলুন জেনে নেই।
যেসকল রাষ্ট্র বা তাদের অঞ্চলগুলো একাধিক মহাদেশে অবস্থিত তাদেরকে আন্তঃমহাদেশীয় দেশ বা Transcontinental Countries বলে।
এমন দেশের কথা ভাবতে গেলেই প্রথমেই চলে আসে রাশিয়া বা তুরস্কের নাম।তাহলে কি শুধুমাত্র রাশিয়া ও তুরস্কই আন্তঃমহাদেশীয় রাষ্ট্র??
জ্বী না।❌
বিশ্বে অনেকগুলো রাষ্ট্র আছে,যারা আন্তঃমহাদেশীয়।
আন্তঃমহাদেশীয় রাষ্ট্র দুই ধরনের।
১.সংলগ্নঃ যেসকল রাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের দুই অংশ দুই মহাদেশে অবস্থিত তারা সংলগ্ন আন্তঃমহাদেশীয় রাষ্ট্র।
২.অসংলগ্নঃ যেসকল রাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড একটি মহাদেশেই অবস্থিত কিন্তু এর অন্তর্গত দ্বীপ বা অঞ্চলসমূহ দুই বা ততোধিক মহাদেশে অবস্থিত,,তাদেরকে অসংলগ্ন আন্তঃমহাদেশীয় রাষ্ট্র বলে।
চলুন আজ জেনে নেই বিশ্বের কিছু আন্তঃমহাদেশীয় দেশ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু তথ্য।
সংলগ্ন আন্তঃমহাদেশীয় দেশসমূহঃ
১.রাশিয়াঃ 🇷🇺
আয়তনে বিশ্বের বৃহত্তম দেশ রাশিয়ার ৭৭% এলাকা এশিয়া মহাদেশে অবস্থিত,বাকি ২৩% ইউরোপে পড়েছে।
সাইবেরিয়া অঞ্চল পুরোটাই এশিয়াতে অবস্থিত।
আমরা জানি,ইউরাল পর্বত,ইউরাল নদী,ককেশীয় পর্বত আর বসফোরাস প্রণালী এশিয়া থেকে ইউরোপকে পৃথক করেছে।
রাশিয়া ইউরাল পর্বতের দুইপাশেই অবস্থিত হওয়ায় এটি এশিয়া ও ইউরোপ দুই মহাদেশেই অবস্থিত।
তবে এর ৭৫% অধিবাসীই ইউরোপীয় অংশে বাস করে,বাকি ২৫% এশিয়াতে।রাজধানী মস্কো পুরোটাই ইউরোপে অবস্থিত।
২.তুরস্কঃ 🇹🇷
তুরস্কে ৯৭% এলাকাই এশিয়াতে অবস্থিত,বাকি ৩% ইউরোপে।
দেশটির সবচেয়ে বড় শহর ইস্তাম্বুল বসফোরাস প্রণালী দ্বারা পৃথক হওয়ায় এটি দুই মহাদেশেই অবস্থিত।
তবে তুরস্কের জনসংখ্যার মাত্র ৫% ইউরোপীয় অঞ্চলে বাস করে,বাকি ৯৫% এশিয়াতে।
৩.মিশরঃ 🇪🇬
পিরামিডের দেশ মিশরের বেশিরভাগ ভূমি উত্তর আফ্রিকাতে অবস্থিত হলেও এর সুয়েজ খালের একাংশ ও পুরো সিনাই উপত্যকা এশিয়া মহাদেশে অবস্থিত।
সিনাই উপত্যকার আয়তন ৬০,০০০ বর্গকিমি।তবে উপত্যকাটিতে খুব অল্পসংখ্যক লোক বাস করে।এশিয়ার এই অঞ্চলটিতে মিশরের দুটি প্রদেশ অবস্থিত।
৪.কাজাখস্তানঃ 🇰🇿
বিশ্বের সর্ববৃহৎ ল্যান্ডলক দেশ কাজাখস্তানের বেশীরভাগ অংশই সেন্ট্রাল এশিয়াতে অবস্থিত।তবে এর কিছু অংশ ইউরাল নদীর মাধ্যমে বিভক্ত হয়ে ইউরোপের মধ্যে পড়েছে।
ইউরাল নদীর পশ্চিমাংশ ইউরোপে অবস্থিত,যা কাজাখস্তানের মোট আয়তনের ১০%।
কাজাখস্তানের আতিরাও এবং পশ্চিম কাজাখস্তান রাজ্যটি ইউরোপ মহাদেশে অবস্থিত।
৫.জর্জিয়াঃ 🇬🇪
জর্জিয়ারও বেশীরভাগ অংশ এশিয়াতে অবস্থিত হলেও এর কিছু এলাকা ককেশীয় পর্বতমালা ও ককেশীয় ওয়াটারশেড দ্বারা পৃথক হয়ে ইউরোপ মহাদেশের মধ্যে পড়েছে।
দেশটির কাজবেকি,খেভসুরেটি এবং তুসেটি জেলা ইউরোপে অবস্থিত,যা দেশটির মোট আয়তনের মাত্র ৫%।
আরও পড়ুনঃ বিশ্বের সবচেয়ে ছোট সীমান্ত রয়েছে যে দেশগুলোর মধ্যে।
৬.আজারবাইজানঃ 🇱🇾
সেন্ট্রাল এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী আরেকটি দেশ আজারবাইজান ককেশীয় পর্বতমালা দুই পাশেই অবস্থিত।
যেহেতু ককেশীয় পর্বতমালা এশিয়া ও ইউরোপকে পৃথক করেছে,সেহেতু দেশটির কিছু এলাকা ইউরোপের মধ্যেও অবস্থিত।
আজারবাইজানের কুসার,সাবরান,সিয়াজান,খাসমাস এবং কুবা জেলাগুলো ইউরোপের মধ্যে অবস্থিত।
তবে ইউরোপ অংশে দেশটির মাত্র ৫% মানুষই বাস করে।
৭.আইসল্যান্ডঃ 🇮🇸
আইসল্যান্ড ইউরেশিয়ান ও উত্তর আমেরিকা প্লেটের উপর অবস্থিত। যেদেশগুলো একাধিক মহাদেশে অবস্থিত,তারমধ্যে এটি অন্যতম।
আইসল্যান্ডের দক্ষিণাংশের রোজেনেস উপদ্বীপ এবং ইংভিলার জাতীয় উদ্যানে গেলে নিজ চোখে দুটি মহাদেশীয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থল দেখা যায়।
টেকটোনিক প্লেট পরিদর্শনের জন্য রোজেনেস উপদ্বীপে দুটি টেকটোনিক প্লেটের উপর একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।
ইংভেলার জাতীয় উদ্যানের টেকটোনিক প্লেট “সিলফা” র ফাটলের মধ্যে একটি গভীর খাদের সৃষ্টি হয়েছে।ফলে আপনি চাইলে এই খাদে নেমে পানির নিচ থেকে দুটি মহাদেশের টেকটোনিক প্লেট দেখে আসতে পারবেন।
৮.কলম্বিয়াঃ 🇨🇴
কলম্বিয়ার প্রায় সকল অংশই দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের মধ্যে অবস্থিত হলেও এর ড্যারিয়ান গ্যাপের পার্শ্ববর্তী আত্রাটো নদীর পশ্চিমাংশ এবং রিও নাপিপি অঞ্চলের উত্তরাংশ টেকটোনিক প্লেট অনুযায়ী উত্তর আমেরিকা মহাদেশ অবস্থিত।
ডারিয়েন গ্যাপ দুই আমেরিকা মহদেশের টেকটোনিক প্লেটকে পৃথক করেছে।
এছাড়া দেশটির সান আন্দ্রেজ ও প্রোভিডেন্সিয়া দ্বীপটি উত্তর আমেরিকাতে অবস্থিত।
সুতারাং,কলম্বিয়াই একমাত্র দেশ যেটি একই সাথে সংলগ্ন ও অসংলগ্ন আন্তঃ মহাদেশীয় দেশ হিসেবে বিবেচিত।
৯.ত্রিনিদাদ ও টোবাগোঃ 🇹🇹
ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ক্ষুদ্রতম এ রাষ্ট্রটি দুই আমেরিকা মহাদেশের টেকটোনিক প্লেটের উপর অবস্থিত।
ত্রিনিদাদের অর্ধেক অংশ দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের টেকটোনিক প্লেটের উপর এবং ত্রিনিদাদের বাকি অংশ ও টোবাগোর পুরো অংশ উত্তর আমেরিকা মহাদেশের মধ্যে অবস্থিত।
অসংলগ্ন আন্তঃমহাদেশীয় রাষ্ট্রঃ
১.যুক্তরাষ্ট্রঃ 🇺🇲
যুক্তরাষ্ট্রের মূলভূমি উত্তর আমেরিকা মহাদেশ অবস্থিত হলেও এর কিছু মালিকানাধীন দ্বীপ অন্য মহাদেশ অবস্থিত।
দেশটির নিয়ন্ত্রিত হাওয়াই,আমেরিকান সামোয়া,গুয়াম,উত্তর মারিয়ানা দ্বীপগুলো ওশেনিয়া মহাদেশে অবস্থিত।
২.যুক্তরাজ্যঃ 🇬🇧
বিশ্বের ৬টি মহাদেশে যুক্তরাজ্যের মালিকানাধীন অঞ্চল রয়েছে।
এর মধ্যে আক্রোতেরি,ঢেকেলিয়া দ্বীপটি এশিয়াতে,সেন্ট হেলেনা,অ্যাসেনশন,ট্রিস্তান দি কুনহা দ্বীপ আফ্রিকাতে,ফকল্যান্ড দক্ষিণ আমেরিকাতে,পিটকেয়ার্ন দ্বীপ ওশেনিয়াতে এবং সাউথ জর্জিয়া,স্যান্ডউইচ দ্বীপ এন্টার্কটিকাতে অবস্থিত।
এছাড়া,উত্তর আমেরিকাতে থাকা ব্রিটিশ অঞ্চলগুলো দেশটি কানাডা,বারমুডা ও যুক্তরাষ্ট্রকে হস্তান্তর করেছে।
৩.ফ্রান্সঃ 🇫🇷
যেদেশগুলো একাধিক মহাদেশে অবস্থিত তার মধ্যে ফ্রান্স অন্যতম। অন্যতম শক্তিশালী দেশ ফ্রান্সেরও ৬ টি মহাদেশে তাদের মালিকানাধীন অঞ্চল রয়েছে।
এরমধ্যে গুয়ার্দোলোপ,মার্টিনিক,সেইন্ট মার্টিন,সেন্ট পিয়েরে,মিকুলুন দ্বীপ উত্তর আমেরিকাতে,মায়োট ও রিইউনিয়ন দ্বীপ আফ্রিকাতে,নর্থ ক্যালিডোনিয়া,ফ্রেন্স পলিনেশিয়া দ্বীপ ওশেনিয়াতে,ফ্রেন্স গায়ানা দ্বীপ দক্ষিণ আমেরিকাতে এবং ওয়েলিস,ফুতুনা,কেরগুলেন দ্বীপ এন্টার্কটিকাতে অবস্থিত।
৪.পর্তুগালঃ 🇵🇹
পর্তুগালের মূলভূমি ইউরোপে।তবে এর মালিকানাধীন মেদিরা,ডেজার্টাস,স্যাভেজ,পোর্তো সান্তো আফ্রিকা এবং ফ্লোরেস,কর্ভো উত্তর আমেরিকা মহাদেশে অবস্থিত।
আরও পড়ুনঃ কোন দেশের কাছে কতটি সাবমেরিন আছে??
৫.নেদারল্যান্ডসঃ 🇳🇱
ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডসের নিয়ন্ত্রণাধীন বোনায়ার,সিন্ট ইউস্টাটিয়াস,সিন্ট মার্টিন ও সাবা দ্বীপ উত্তর আমেরিকায় এবং কুরাকাও,আরুবা দ্বীপ দক্ষিণ আমেরিকাতে অবস্থিত।
৬.স্পেনঃ 🇪🇦
ইউরোপীয়ান দেশ স্পেনের নিয়ন্ত্রণে থাকা ক্যানারি দ্বীপ,সিউটা ও মেলিলা অঞ্চলটি আফ্রিকা মহাদেশে অবস্থিত।
৭.ইতালিঃ 🇮🇪
ইতালির মূলভূমি ইউরোপে অবস্থিত।
দেশটির মালিকানাধীন দুইটি দ্বীপ ল্যাম্পেডুসা এবং ল্যাম্পিওন আফ্রিকা মহাদেশ অবস্থিত।
৮.নরওয়েঃ 🇳🇴
বিশ্বের সবচেয়ে শান্তির দেশ নরওয়ের মূল ভূখন্ড ইউরোপে অবস্থিত হলেও এর পিটার,বুভেট দ্বীপ ও কুইন মডল্যান্ড অঞ্চলটি এন্টার্কটিকাতে অবস্থিত।
৯.গ্রিসঃ 🇬🇷
ইউরোপে মূলভূমি থাকলেও গ্রিসের নিয়ন্ত্রণাধীন রোডস,চিওস,কস,সামোস,লেসবস,বাস্তেলোরিজো,স্ট্রংগিলি,রো দ্বীপগুলো ভৌগোলিকভাবে এশয়ান মাইনর উপকূলে অবস্থিত।
১০.ডেনমার্কঃ 🇩🇰
ইউরোপের অন্যতম ধনী দেশ ডেনমার্কের নিয়ন্ত্রণাধীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ দ্বীপ গ্রীনল্যান্ড উত্তর আমেরিকা মহাদেশে অবস্থিত।
১১.জাপানঃ 🇯🇵
সূর্যদয়ের দেশ জাপানের মূলভূমি পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত।তবে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ওগাসাওয়া,মিনামি তোরিশিমা,ওকিনো তোরিশিমা, নিশিনোশিমা,বনিন দ্বীপপুঞ্জ ওশেনিয়াতে অবস্থিত।
১২.ইন্দোনেশিয়াঃ 🇮🇩
মূল ভূখন্ড এশিয়াতে অবস্থিত হলেও দেশটির নিয়ন্ত্রিত পাপুয়া দ্বীপের একাংশ ওশেনিয়া মহাদেশে অবস্থিত।
দ্বীপটি ইন্দোনেশিয়া ও পাপুয়া নিউগিনির যৌথ মালিকানাধীন।তাই পাপুয়া দ্বীপে দুইদেশ তাদের ল্যান্ড বর্ডার শেয়ার করেছে।
১৩.ইয়েমেনঃ 🇾🇪
আরব উপদ্বীপে অবস্থিত ইয়েমেনের মূলভূমি এশিয়াতে অবস্থিত।
তবে বাবেল মানদেব প্রণালীর কাছে অবস্থিত সোকোত্রা দ্বীপটি আফ্রিকা মহাদেশে অবস্থিত।
আরও পড়ুনঃ আয়তনে বাংলাদেশের বড় দশটি উপজেলা!!
১৪.চিলিঃ 🇨🇱
দেশটির মূল ভূখন্ড দক্ষিণ আমেরিকাতে অবস্থিত।তবে এর ইস্টার আইল্যান্ড দ্বীপটি ওশেনিয়াতে এবং দক্ষিণ শেটল্যান্ড,চোরকোট,আলেকজান্ডার,এলসওয়ার্থল্যান্ড দ্বীপগুলো এন্টার্কটিকা মহাদেশে অবস্থিত।
১৫.ভেনিজুয়েলাঃ 🇻🇪
ভেনিজুয়েলা পুরোটাই দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ অবস্থিত হলেও এর ছোট একটি দ্বীপ ইসলা এভেজ উত্তর আমেরিকা মহাদেশে অবস্থিত।
১৬.ইকুয়েডরঃ 🇪🇨
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরের মালিকানাধীন গ্যালাপাগোস দ্বীপটি ওশেনিয়া মহাদেশে অবস্থিত।
১৭.অস্ট্রেলিয়াঃ 🇭🇲
ওশেনিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়ার মালিকানাধীন ম্যাকডোনাল্ড,হার্ড আইল্যান্ড দ্বীপটি অ্যান্টার্কটিকাতে এবং ক্রিসমাস,কোকোস দ্বীপটি এশিয়া মহাদেশে অবস্থিত।
তথ্যসূত্রঃ
১.https://en.m.wikipedia.org/wiki/List_of_transcontinental_countries
২.https://www.worldatlas.com/articles/which-are-the-transcontinental-countries-of-our-world.html
৩.https://worldpopulationreview.com/country-rankings/transcontinental-countries
৪.https://unacademy.com/content/upsc/study-material/general-awareness/transcontinental-countries-such-as-egypt/
৫.https://landedtravel.com/destinations/colombia-caribbean-isles/
৬.https://perlan.is/articles/tectonic-plates-iceland
৭.https://www.icelandontheweb.com/articles-on-iceland/nature/geology/tectonic-plates
৮.https://dashamlav.com/transcontinental-countries/