জেলা বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর।বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোকে গতিশীল করতে দেশের কয়েকটি বড় অঞ্চলকে বিভাগ,বিভাগকে আবার কয়েকটি জেলায় এবং জেলাকে আবার কয়েকটি উপজেলায় বিভক্ত করা হয়েছে।
দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানের জেলার সংখ্যা ছিলো ১৭ টি।স্বাধীন বাংলাদেশের জেলার সংখ্যা ছিলো ১৯ টি।পরবর্তীতে সাবেক রাস্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৮৪ সালে ৪৫ টি মহকুমাকে জেলায় রুপান্তরিত করে।ফলে মোট জেলার সংখ্যা হয় ৬৪ টি।স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম জামালপুর মহাকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়।
আসুন আজ জেনে নেই বাংলাদেশের এই ৬৪ টি জেলার মধ্যে আয়তনে সবচেয়ে ছোট ১০ টি জেলার নাম।
১.নারায়নগঞ্জঃ (৬৮৩.১৪ বর্গ কি.মি)
বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের জেলা নারায়ণগঞ্জের আয়তন ৬৮৩.১৪ বর্গকিমি।আয়তনে এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট জেলা।এটিই ঢাকা শহরের সবচেয়ে কাছের জেলা।
সোনালী আঁশ পাটশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ এই শহরকে প্রাচ্যের ড্যান্ডি বলা হয়।দেশের অত্যন্ত প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ শহর সোঁনারগাও এই জেলারই অন্তর্গত। ঢাকা বাংলার রাজধানী হওয়ার অনেক পূর্বেই সোঁনারগাও ছিলো প্রাচীন বাংলার রাজধানী।
ইতিহাসখ্যাত মসলিন কাপড় তৈরি হতো এই জেলাতেই।মিশরের মমির শরীরে পেঁচানো মসলিন কাপড় এই সোনারগাঁওয়েই তৈরি করা হয়েছিলো।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর গড় উচ্চতা ১৩ মিটার বা ৩২ ফুট।নায়ায়ণগঞ্জের উপজেলারখ্যা ৬ টি।আছে একটি সিটি কর্পোরেশন ও একটি পৌরসভা।
২.মেহেরপুর (৭১৬.০৮ বর্গ কি.মি)
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা মেহেরপুর।এর আয়তন ৭১৬.০৮ বর্গকিমি
।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অত্যন্ত স্মৃতি বিজড়িত স্থান এই জেলা।মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার গঠিত হয় মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে।একে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানীও ঘোষণা করা হয়।
এর উপজেলার সংখ্যা ৩টি,পৌরসভা ২ টি।জেলাটিতে প্রচুর আমের চাষ হয়।
আরও পড়ুন: আয়তনে বাংলাদেশের বড় দশটি জেলা।
৩. ঝালকাঠিঃ (৭৫৮.০৬ বর্গ কি.মি)
এটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা।আয়তন ৭৫৮. ০৬ বর্গকিমি।জেলাটি পদ্মা-মেঘনার পললভূমি দ্বারা সৃষ্ট।
বিভিন্ন সময়ে এখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি,ডাচ,ফরাসি রা ব্যাবসাকেন্দ্র খুলেছিলো।বানিজ্যিক গুরুত্বের জন্য একে ২য় কলকাতা বলা হতো।প্রাচীনকালেই এখনে একটি নদীবন্দর ছিলো।
শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক,কামিনী রায়ের পৈত্রিকভিটা এ জেলাতেই অবস্থিত। এর উপজেলার সংখ্যা ৪ টি,পৌরসভা ২ টি।জেলাটিতে প্রচুর পেয়ারার চাষ হয়।
৪.ফেনীঃ (৯২৮.৩৪ বর্গ কি.মি)
এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি জেলা।আয়তন ৯২৮.৩৪ বর্গকিমি।ফেনী নদীর নামানুসারে এই জেলাটির নামকরণ করা হয়।
ধারণা করা হয় দূর অতীতে এ অঞ্চলটি সাগরের অংশ ছিলো।তবে উত্তর-পূর্বদিক ছিলো পাহাড়ে ঘেরা।পূর্বদিকের পাহাড়ে আদিম জনগোষ্ঠীর বাস ছিলো বলে ধারণা করা হয়।
১৯৬৩ সালে ছাগলনাইয়াতে একটি পুকুর খননকালে প্রায় ৫০০০ বছরের পুরাতন একটি হাতকুড়াল পাওয়া যায়।এর উপজেলার সংখ্যা ৬ টি,পৌরসভা ৫ টি।
৫.মুন্সিগঞ্জঃ (৯৫৪.৯৬ বর্গ কি.মি)
বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের জেলা এটি।আয়তন ৯৫৪.৯৬ বর্গকিমি।উপজেলার সংখ্যা ৬টি,পৌরসভা আছে ২টি।
প্রাচীন নাম ছিলো ইদ্রাকপুর।তবে বিক্রমপুর নামে সর্বাধিক পরিচিত ছিলো।জেলাটি পুরোপুরি সমতল এলাকা না।এর কিছু কিছু জায়গা যথেষ্ট উঁচু,তবে কোনো পাহাড় নেই।তবে বেশীরভাগই নিম্নভূমি।
প্রাচীনকালে একটি প্রশিদ্ধ শহর ছিলো মুন্সিগঞ্জ।খ্রিস্টিয় ৮ম-১৩শ শতক পর্যন্ত এটি চন্দ্র,বর্মন,সেন রাজাদের রাজধানী ছিলো।পদ্মা সেতুর মাওয়া অংশটি এ জেলাতেই অবস্থিত।
মুন্সিগঞ্জের রামপালের কলার সুখ্যাতি ছিলো দেশ-বিদেশজুড়ে।দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হতো বিদেশেও।
৬.জয়পুরহাটঃ (৯৬৫.৪৪ বর্গ কি.মি)
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশের জেলা জয়পুরহাট।আয়তন ৯৬৫.৪৪ বর্গকিমি।এটি বাংলাদেশের ৭ টি নিরক্ষরমুক্ত জেলার মধ্যে অন্যতম।
জয়পুরহাটের ইতিহাস খুবই অস্পষ্ট। কারণ তৎকালীন ভারতবর্ষে জয়পুরহাট নামের কোনো অঞ্চল ছিলোনা। স্থানীয় নাম ছিলো বাড়াবাড়িহাট।এই বাঘাবাড়িহাট আর পাঁচবিবি উপজেলা মিলে ছিলো লালবাজার থানা।
১৯৭১ সালের ১লা জানুয়ারী জয়পুরহাট মহকুমা গঠিত হয়,জেলা হয় ১৯৮৪ সালে।এর বর্তমান উপজেলার সংখ্যা ৫ টি,পৌরসভাও ৫ টি।
৭.নড়াইলঃ (৯৯০.১৮ বর্গ কি.মি)
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা নড়াইলের আয়তন ৯৯০.১৮ বর্গকিমি। উপজেলার সংখ্যা ৩ টি,থানা ৪ টি ও পৌরসভা আছে ৩ টি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নড়াইল জেলার অবদান অপরিসীম। মুক্তিযুদ্ধাদের সংখ্যাধিক্যে বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম জেলা এটি।
জেলায় বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদসহ ২ জন বীরউত্তম,১ জন বীরবিক্রম ও ৩ জন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধা আছেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে শাহাদাৎ বরণকারীর সংখ্যাও একেবারে কম নয়।
পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক চিত্রা নদীর পাড়ে লঞ্চঘাটের পল্টুনের উপর ২৮০০ লোককে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।লোহাগড়ার ইটনাতে ৫৮ জন লোককে হত্যা করে।
নড়াইল হানাদারমুক্ত হয় ১০ ডিসেম্বরে।
আরও পড়ুন: আয়তনে বাংলাদেশের বড় দশটি উপজেলা।
৮.মাগুরাঃ (১০৪৯ বর্গ কি.মি)
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা মাগুরা।আয়তন ১০৪৯ বর্গকিমি।উপজেলার সংখ্যা ৪ টি,পৌরসভা ১টি।
বাংলাদেশের প্রথম নিরক্ষরমুক্ত জেলা হল মাগুরা।একসময় এই অঞ্চলে মগ জলদস্যুদের ব্যপক বিচরণ ছিলো।এদের দমন করতে ১৮৪৫ সালে মাগুরা মহকুমা গঠিত হয়।
জেলাটি সমুদ্রসমতল হতে ২৬ ফুট উঁচুতে অবস্থিত।দারিদ্র্যের মাপকাঠিতে এটি বাংলাদেশের ৪র্থ দরিদ্র জেলা।
৯.রাজবাড়িঃ (১০৯২.৩০ বর্গ কি.মি)
এটি বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের একটি জেলা।আয়তন ১০৯২.৩০ বর্গকিমি।এর উপজেলার সংখ্যা ৫ টি,পৌরসভা ৩টি।রাজবাড়ি জেলার নামকরণ যে কোনো রাজার বাড়ির নামানুসারে হয়েছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
এই জেলার উপজেলাগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিলো।পূর্বে এ জেলার কিছু অংশ নাটোরের জমিদারীর অংশ ছিলো।
১৮৫৯ সালে পাংশা ও বালিয়াকান্দিকে কুমারখালি মহাকুমার অন্তর্ভুক্ত করা হয়,যা ছিলো পাবনা জেলার অধীনে।এরপর একে যশোরের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৮১১ সালে ফরিদপুর জেলা গঠিত হলে পাংশা ও রাজবাড়ি মিলে গোয়ালন্দ মহকুমা গঠিত হয়,যার সদর দফতর ছিলো রাজবাড়িতে।পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে একে জেলায় উন্নীত করা হয়।
১০.নরসিংদীঃ (১১৪০.৭৬ বর্গ কি.মি)
জেলাটি বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত।আয়তন ১১৪০.৭৬ বর্গকিমি।এর উপজেলা সংখ্যা ৬ টি,পৌরসভা আছে ৬ টি।এর উত্তর অংশে লালমাটির পাহাড়ি ভূমি আছে।
নরসিংদীর বেলাবোতে রয়েছে ২৫০০ বছরের প্রাচীন শহর উয়ারী-বটেশ্বর।ধারণা করা হয় পাকিস্তানের হরপ্পার পর এটিই ভারতীয় উপমহাদেশে গড়ে ওঠা ২য় প্রাচীন সভ্যতা।এটি মূলত একটি দূর্গনগরী ছিলো।
অর্থনৈতিক দিক দিয়েও জেলাটির গুরুত্ব অপরিসীম।জেলাটিতে বহু শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে।