বাংলাদেশ।আয়তনে ছোট্ট একটি দেশ।বনভূমির পরিমাণও খুবই কম।বিগত ১০০ বছরে দেশে অতিরিক্ত বনভূমি না থাকলেও যা ছিলো তো যথেষ্ট পরিমাণে।তখন জীববৈচিত্র্যেও ভরপুর ছিলো এই দেশ।তবে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যই আমরা হারিয়েছি তাদেরকে।হারাতে চলেছি আরও কিছু প্রাণীকেও। বাংলাদেশের বিলুপ্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো কারা?
বাংলাদেশ বন বিভাগ ও আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (IUCN) বাংলাদেশের ১৬১৯ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর বর্তমান অবস্থা নিয়ে ২০১৪-১৫ সালে একটি সমীক্ষা চালিয়েছে।বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা প্রাণীগুলোকে লালতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী,বিগত ১০০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৩১ টি বন্যপ্রাণী সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।এরমধ্যে ১১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী,১৯ প্রজাতির পাখি ও একটি সরীসৃপ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
মহাবিপন্নের তালিকায় আছে ৫৬ টি প্রজাতি,বিপন্ন ১৮১ টি প্রজাতি ও ঝুঁকিতে আছে ১৫৩ টি প্রজাতি।ঝুঁকির কাছাকাছি আছে ৯০ টি প্রজাতি।পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত আছে ৮০২ টি প্রজাতি।পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায়নি ২৭৮ টি প্রজাতি সম্পর্কে,সংখ্যা নির্ধারণ করা যায়নি ২৮ টি প্রজাতির।তবে এরাও সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত।
বিলুপ্ত প্রাণী বলতে কি বোঝায়?
যেসকল প্রাণী প্রজাতি কোনো একটি নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চল,দেশ বা পুরো পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে,যাদেরকে আর পাওয়া যায়না,তাদেরকে বিলুপ্ত প্রাণী বলে।কোনো প্রাণী একটি নির্দিষ্ট এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন হলে,তাকে স্থানীয় বিলুপ্তি বলে।বাংলাদেশ থেকে যেসকল প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে সেগুলোর অস্তিত্ব পৃথিবীতে এখনও আছে।সুতারাং এখানে স্থানীয় বিলুপ্তি ঘটেছে।
বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হওয়া ৩১ টি প্রাণীর মধ্যে ১১টি স্তন্যপায়ী হলঃ ডোরাকাটা হায়েনা,ধূসর নেকড়ে,নীলগাই,বনগরু,সুমাত্রা গন্ডার,জাভা গন্ডার,ভারতীয় গন্ডার,জলার হরিণ,কৃষ্ণমৃগ,বুনোমোষ,শ্লথ ভাল্লুক।
তালিকায় ১৯ টি পাখিও আছে।এগুলো হলঃ লালমুখ দাগিডানা,বড় সারস,ধূসর মেটে তিতির,বাদা তিতির,বাদিহাঁস,গোলাপী হাঁস,বড় হাড়গিলা,ধলাপেট বক,সাদাফোঁটা গগণবেড়,রাজশকুন,দাগিবুক টিয়াঠুঁটি,লালমাথা টিয়াঠুঁটি,গাছআচড়া,সবুজ ময়ুর,বড় মদনটাক,বাংলা ডাহর,পাতি ডাহর,লাল বাটাই,দেশী ময়ুর।
তালিকার একমাত্র হতভাগা সরীসৃপ হলঃ মিঠাপানির কুমির।
আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশের নির্বিষ বা অবিষধর সাপ কোনগুলো??
চলুন আজ জেনে নেই বাংলাদেশের বিলুপ্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো র মধ্যে ৬ টি প্রাণী সম্পর্কে।বিস্তারিত তথ্যবহুল বর্ণণা দেওয়ায় পাঠকদের পড়ার সুবিধার্থে দুটি পর্বে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি প্রকাশ করা হবে।
১.ডোরাকাটা হায়েনাঃ
বাংলাদেশে এককালে হায়েনা ছিলো,তা ভাবতেও অবাক লাগে।হায়েনার কথা চিন্তা করলেই মনে পড়ে যাই ডিসকোভারি বা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে দেখানো হিংস্র হায়েনাগুলোকে।
আমাদের দেশে যেগুলো পাওয়া যেতো সেগুলো যথেষ্ট ছোট ছিলো।বড়জোর একটা কুকুরের সমান বা কিছুটা বড়।
পূর্বে ধারণা করা হতো এরা নেকড়ে বা কুকুরগোত্রীয়।কিন্তু হায়েনারা কোনো ক্রস ব্রিড না,এরা স্বতন্ত্র প্রাণী।
ডোরাকাটা হায়েনাদের নাক,কান আর গলা কালো রঙের হয়।বাকি সারা শরীরে হলুদ,বাদামি,ধূসর,কালো ইত্যাদির মিশ্র স্ট্রাইপ থাকে।
এদের ওজন ২৬-৪১ কেজি।বন্য অবস্থায় এদের গড় আয়ু ১০-১৫ বছর।
পুরুষ ও মহিলা হায়েনা দেখতে প্রায় একইরকম।মহিলারা পুরুষদের উপর প্রভাব বিস্তারকারী।
এদের তীব্র ঘ্রাণশক্তি,তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি থাকে।শ্রবণশক্তিও প্রবল।আচরণেও বেশ আক্রমণাত্বক।অত্যন্ত দ্রুতগতিসম্পন্ন প্রাণী।এদের চোয়াল ও দাঁত অনেক শক্তিশালী।
জঙ্গল,ঘন ঝোপঝাড়,কবরস্থান,উঁচু টিলা,আখের খেত ইত্যাদি ছিলো থাকার জন্য এদের পছন্দের জায়গা।বরেন্দ্রভূমিতেও এরা দাঁপিয়ে বেড়াতো,দলবদ্ধ হয়ে শিকারে অংশ নিতো।
ডোরাকাটা হায়েনা নিশাচর প্রাণী।বাংলাদেশের হায়েনাগুলোর ক্ষেত্রে গবাদিপশুই ছিলো এদের প্রধান খাদ্য।এছাড়া হাঁস-মুরগি,ছোট কুকুর,হরিণ,বন্য শুয়োর,সজারু ইত্যাদিও খেতো।
রাতে যখন চিৎকার করতো তখন এদের ডাক অনেকটা পাগলের হাসির মতো শোনাতো।
বাংলাদেশের রাজশাহী,দিনাজপুর,রংপুর এবং খুলনা বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এদের বিচরণ ছিলো।
ধারণা করা হয় উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে বিংশ শতকের প্রথমদিকে এটি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়।
খাদ্যের অপ্রতুলতা,আবাসস্থল ধ্বংস,নির্বিচারে হত্যা ইত্যাদি এদেশ থেকে ওদের বিলুপ্তির প্রধান কারণ।
এছাড়া বিভিন্ন কবিরাজি ঔষধে এদের লিভার ব্যবহার করাও এদের বিলুপ্তির অন্যতম কারণ।
এখনও ভারত,নেপাল,পাকিস্তান,উত্তর আফ্রিকাতে প্রায় ৫-১০ হাজার ডোরাকাটা হায়েনা জীবিত আছে।
২.ধূসর নেকড়েঃ
বাংলাদেশের বিলুপ্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো র মধ্যে ধূসর নেকড়ে উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশেও এককালে নেকড়ে দলবেঁধে শেয়ালের মতো খোলা প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতো।সুযোগ পেলেই গবাদিপশু,হাঁস-মুরগি নিয়ে দৌড় দিতো।
তবে বাংলাদেশের ধূসর নেকড়েগুলো ছিলো অন্যান্য নেকড়েদের থেকে অনেকটা ছোট।এরা কুকুরগোত্রীয় প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বড়।ধূসর শেয়ালের সাথে এদের অনেকটা মিল আছে।
এদের ধূসর বাদামি শরীরে সাদা,কালো ছোপছোপ দাগ থাকে।নাক কালো রঙের।চোখ হলুদাভ।
এদের ওজন ১৭-২৫ কেজি।এদের গড় আয়ু ৬-৮ বছর।তবে উপযুক্ত বন্য পরিবেশে প্রায় ১৩ বছরও বাঁচতে পারে।
পুরুষ নেকড়েরা মহিলা নেকড়ে থেকে কিছুটা বড়।
ধূসর নেকড়েরা সামাজিক জীব।৬-৮ জনের একটি দল নিয়ে এরা চলাফেরা করে।দলটি খুব কঠোরভাবে নেতৃত্ব মানে।
শিকার ধরার পর দলপতি ও তার সঙ্গী প্রথমে খায়।পরবর্তীতে তা ক্রমন্বয়ে প্রত্যেকের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়।
সাধারণত ঘন জঙ্গল,তৃণভূমি,ঝোপঝাড়,পত্রঝরা বন,কৃষিজ জমিতে বাস করতো।
শিকারের জন্য এদের কোনো সময় বাছবিছার নেই।যখন-তখন মানুষের সামনে থেকেই ছাগল,ভেড়া,হাঁস-মুরগি তুলে নিয়ে যেতো।
এদের প্রধান শিকার ছিলো গবাদিপশু।এরা মানুষকে আক্রমণ না করলেও ছোট শিশুদের তুলে নিয়ে যাওয়ার বদনাম রয়েছে।
ব্রিটিশ বাংলাদেশে এদের ব্যপক সংখ্যাবৃদ্ধি আর শিকারের মাত্রা চরম পর্যায়ে উড়ে যাওয়ার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নেকড়ে নিধনের সিদ্ধান্ত নেয়।এর জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করে।
বাংলাদেশের রাজশাহী,রংপুর,দিনাজপুর,নোয়াখালী,পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এদের অবাধ বিচরণ ছিলো।
তবে গবাদিপশু,হাঁস-মুরগি শিকার করার কুখ্যাতির কারণে এদেরকে নির্বিচারে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো।ফলে ধীরে ধীরে এরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে সর্বশেষ স্থানীয় ধূসর নেকড়ে পাওয়া গেছিলো ১৯৪৯ সালে নোয়াখালীতে।
তবে ২০১৮ সালে বরগুনার সুন্দরবন অঞ্চলে একটি ধূসর নেকড়ে পাওয়া যায়,যাকে গ্রামবাসীরা পিটিয়ে হত্যা করে।
ধারণা করা হয়,ঘূর্ণিঝড় ফণীর সময় একটি নেকড়ে ভারত থেকে এদেশে চলে আসে।স্থানীয়ভাবে কোনো নেকড়ে থাকার সম্ভাবণা বাংলাদেশে নেই।তবে এ ব্যাপারে এখনও অনুসন্ধান চলছে।
তবে বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হলেও ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল,উত্তর আমেরিকা,ভারত,পাকিস্তান,তিব্বত,ইরান,রাশিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে প্রায় ২-২.৫ লাখ ধূসর নেকড়ে এখনও টিকে আছে।
আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে যে স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো।। পর্ব-২
৩.জাভা গন্ডারঃ
বাংলাদেশ একসময় প্রকৃতির আশির্বাদপুষ্ট ছিলো।কেননা সারা পৃথিবীর ৫ প্রজাতির গন্ডারের ৩ প্রজাতিই বাংলাদেশে পাওয়া যেতো।
কিন্তু দুঃখের বিষয়,আমরা তাদের ধরে রাখতে পারিনি।
জাভা গন্ডার ধূসর বা ধূসর বাদামি রঙের হয়।অন্যসব গন্ডারদের মতো এদের চামড়াও অনেক মোটা।চামড়ায় অনেকগুলো ভাঁজ থাকে,যা অনেকটা বর্মের মতে দেখায়।
জাভা গন্ডার অনেকটাই ভারতীয় গন্ডারের মতোই দেখতে।তবে এরা ভারতীয় গন্ডার থেকে কিছুটা ছোট,মাথাও ছোট হয়।
এদেরও একটা শিং থাকে।স্ত্রীদের সাধারণত কোনো শিং থাকেনা,তবে ছোট উঁচু অংশ থাকতে পারে।
এদের শিঙের দৈর্ঘ্য ২৫ সেমি এর কম হয়।ওজন ৯০০-২৩০০ কেজি।এদের বন্য অবস্থায় গড় আয়ু ৩০-৪৫ বছর।
পুরুষেরা মহিলাদের থেকে কিছুটা বড় হয়।
জাভা গন্ডার নিঃসঙ্গ জীবণযাপন করে।এদের ঘ্রাণশক্তি অনেক ভালো।অন্যান্য গন্ডার থেকে কান ছোট হলেও শ্রবণশক্তি অনেক প্রখর।তবে দৃষ্টিশক্তি খুবই ক্ষীণ।
এদের শিং অন্যসব এশিয়ান গন্ডারদের থেকে ছোট।তবে শিং ভেঙে গেলে পুণরায় তা বৃদ্ধি পায়।
ভেজা তৃণভূমি,পত্রঝরা বন,বন্যাপ্রবণ অঞ্চল,এমনকি ম্যানগ্রোভ অঞ্চলেও এদেরকে পাওয়া যেতো।খাদ্যাভাসে এরা নিমিষভোজী।
সাধারণত মানুষকে এড়িয়ে চললেও ভয় পেলে আক্রমণ করে।এদের দূর্লভতার কারণে বিজ্ঞানীরা জাভা গন্ডার সম্পর্কে খুব অল্পই জানেন।
একসময় বাংলাদেশের সুন্দরবন,যশোর,বরিশাল,সিলেট,ময়মনসিংহের গারো পাহাড়,পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে জাভা গন্ডার পাওয়া গেলেও বাংলাদেশ থেকে এখন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত।
সর্বশেষ খুলনার রায়সাহেব নলিনীকান্ত রায়চৌধুরী ১৮৮৫ সালে সুন্দরবনে জাভা গন্ডারের পায়ের ছাপ পাওয়ার দাবি করে।এরপর আর বাংলাদেশের কোথাও এ গন্ডার পাওয়া যায়নি।
মূলত,শিং আর মোটা চামড়ার লোভে নির্বিচারে গন্ডার শিকার কারণে এরা ধীরে ধীরে এদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
গন্ডারের চামড়া দিয়ে বর্ম বানানোর রেওয়াজ ও অনেক প্রাচীনকাল থেকেই।
বাংলার বারো ভূঁইয়াদের রাজা প্রতাপাদিত্যের সৈন্যদের বর্মও সুন্দরবমের গন্ডারের চামড়া দিয়ে তৈরি করা হতো।
এরা শুধু বাংলাদেশ না,পুরো বিশ্ব থেকেও বিলুপ্তির দোরগড়ায়।সারা পৃথিবীতে সর্বসাকুল্যে ৩৫-৫০ টির মতো জাভা গন্ডার থাকতে পারে।
বর্তমানে এরা শুধুমাত্র এদের প্রাচীন আবাসভূমি ইন্দোনেশিয়ার জাভা র উজুং কুলন জাতীয় উদ্যানেই টিকে রয়েছে।এছাড়া বিশ্বের আর কোথাও জাভা গন্ডার দেখা যায়নি।
৪.সুমাত্রা গন্ডারঃ
পৃথিবীতে পাওয়া পাঁচ প্রজাতির গন্ডারের মধ্যে বাংলাদেশে জাভা,সুমাত্রান,ভারতীয়,এই তিনধরনের গন্ডার পাওয়া যেতো।
পৃথিবীর সব প্রজাতির গন্ডারদের মধ্যে সুমাত্রা গন্ডারই সবচেয়ে ছোট এবং সবচেয়ে বেশী বিলুপ্তির ঝুঁকিতে।
সুমাত্রা গন্ডার অন্যসব এশিয়ান গন্ডারদের থেকে অনেকটাই আলাদা।
এদের দেহ লালচে বাদামি রঙের।ত্বকে অনেকগুলো ভাঁজ থাকে।সমস্ত শরীর ছোট ছোট লোম দ্বারা আবৃত থাকে,যা অন্যদের থাকেনা
।আফ্রিকান গন্ডারদের মতো এদেরও দুইটা শিং থাকে।
এদের প্রধান শিংটি ২৫-৭৯ সেমি পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে।ছোটটির দৈর্ঘ্য ১০ সেমি র চেয়েও কম।
এদের ওজন ৫০০-৯৫০ কেজি পর্যন্ত হয়।গড় আয়ু ৩৫-৪০ বছর।
অন্যান্য গন্ডারদের মতো এরাও একাকী জীবণযাপন করে।দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হলেও শ্রবণশক্তি ও ঘ্রাণশক্তি প্রখর।ছোট হওয়ায় অত্যন্ত ক্ষীপ্রগতিসম্পন্ন।গতির দিক দিয়ে কালো গন্ডারদের পরেই এদের অবস্থান।
সাধারণত গীষ্মমন্ডলীয় বনভূমিতেই সুমাত্রান গন্ডার বাস করতে পছন্দ করতো।গীষ্মমন্ডলীয় উচ্চভূমি,জলাভূমি সর্বত্রই এদের বিচরণ ছিলো।
এরাও অন্যান্য গন্ডারের মতোই নিরামিষভোজী।ঘাস,গুল্ম,পাতা,ফলমূলই এদের প্রধান খাদ্য ছিলো।
গোপনীয় ও একাকী জীবণযাপন আর দূর্লভতার কারণে এদের স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে খুবই কমই জানা গেছে।তবে ধারণা করা হয় এরা অনেক প্রাচীন প্রজাতি ও পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত উলেন গন্ডারের বংশধর।
বাংলাদেশের কুমিল্লা,পার্বত্য চট্টগ্রাম,কক্সবাজারে এদের বাস করার রেকর্ড থাকলেও এখন তা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত।
বাংলাদেশে সর্বশেষ ১৮৬৭ সালে চট্টগ্রামের সাঙ্গু নদীর পাড়ে সুমাত্রা গন্ডার ধরা পড়ে।
তা ১৮৭২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ৫০০০ পাউন্ডের বিনিময়ে লন্ডন চিড়িয়াখানায় বিক্রি করে দেয়।চিড়িয়াখানায় এর নাম ‘বেগম’ রাখা হয়,যা ১৯০০ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলো।এরপর আর বাংলাদেশের কোথাও সুমাত্রা গন্ডার পাওয়া যায়নি।
শিং ও চামড়ার জন্য শিকার,কৃষি ও বাসস্থানের জন্য বনাঞ্চল ধ্বংস করা ইত্যাদি কারণে এরা দেশ থেকে আজ বিলুপ্ত।বিশ্ব থেকেও সুমাত্রা গন্ডার আজ বিলুপ্তির পথে।
বর্তমানে এই প্রজাতিটি শুধুমাত্র ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রার বরিসন সেলেতান উদ্যান ও ওয়ে কাম্বাস জাতীয় উদ্যানেই নিবিড়ভাবে সংরক্ষিত আছে,যার সংখ্যা ৮০ র ও কম।
৫.ভারতীয় গন্ডারঃ
এশিয় গন্ডারগুলোর মধ্যে ভারতীয় গন্ডারই সবচেয়ে বড় ও বৃহৎ পরিসরে পাওয়া যায়।
এরা ছাই ধূসর বর্ণের।শরীরে অন্যান্য গন্ডারদের মতোই ভাঁজ থাকে।গন্ডারদের শরীরে থাকা এ ভাঁজগুলো এদের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।অন্যান্য গন্ডারের চেয়ে ভারতীয় গন্ডারের চামড়া অনেকটা পুরু।চামড়ায় কোনো লোম থাকেনা।
এদের শিংয়ের গড় দৈর্ঘ্য সাধারণত ২০-৩০ সেমি হয়।তবে সর্বোচ্চ ৫৭.২ সেমি দৈর্ঘ্যের শিং পাওয়ারও রেকর্ড আছে।
এদের ওজন ১৮০০-২৭০০ কেজির মধ্যে হয়।গড় আয়ু ৩৫-৪৫ বছর।
এরা বেশ লাজুক স্বভাবের,কাউকে শত্রু মনে করলে আক্রমণের বদলে পালিয়ে যায়।তবে মেটিং পিরিয়ড আর সন্তান বাঁচানোর ক্ষেত্রে আক্রমণাত্বক হয়।
অন্যান্য গন্ডারদের মতোই এদের শ্রবণ ও ঘ্রাণশক্তি প্রবল,তবে দৃষ্টি ক্ষীণ।এরাও অনেক ক্ষীপ্রগতিতে দৌড়াতে পারে।ভারতীয় গন্ডার প্রায় ১০ ধরনের শব্দ করতে পারে।
অন্যন্য প্রজাতির তুলনায় ভারতীয় গন্ডার ভালো সাঁতারু ও কাদায় বেশী সময় থাকে।সকাল ও সন্ধ্যায় খাবার খায়,বাকিসময় কাদামাটিতে বা শীতল জায়গায় বিশ্রাম নেয়।
এরাও নিরামিষভোজী।ঘাস,পাতা,ছোট গুল্ম,ফলমূল ইত্যাদি খেয়ে থাকে।সাথে প্রচুর খনিজ খায়।
প্লাবন সমভূমি,ঘাসের জমি,চিরসবুজ বনভূমি এদের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা।গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা এদের প্রধান বিচরণক্ষেত্র ছিলো।
একসময় বাংলাদেশের সিলেট,ময়মনসিংহ,রংপুর,দিনাজপুর অঞ্চলে ভারতীয় গন্ডার দেখা গেলেও বর্তমানে তা বাংলাদেশ থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত।
ধারণা করা হয় ১৯৩০ এর দশকে ভারতীয় গন্ডারের বিলুপ্তি ঘটে।
শিং ও চামড়ার জন্য হত্যা,বাসস্থান ধ্বংসের কারণে বাংলাদেশ থেকে গন্ডারের বিলুপ্তি ঘটেছে অথবা মাইগ্রেট হয়ে পার্শ্ববর্তী আসাম ও মনিপুরে চলে গিয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হলেও বিশ্বে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভারতীয় গন্ডার এখনো বেঁচে আছে।
ভারত ও নেপালে বর্তমানে প্রায় ৩৭০০ ভারতীয় গন্ডারের অস্তিত্ব রয়েছে।
আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশের নির্বিষ বা অবিষধর সাপ কোনগুলো??
৬.শ্লথ ভাল্লুকঃ
বাংলাদেশের বিলুপ্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো র মধ্যে ই নবীনতম।
বাংলাদেশে একসময় দুই প্রজাতির ভাল্লুক পাওয়া গেলেও বর্তমানে শ্লথ ভাল্লুক বিলুপ্ত,কিছু সংখ্যক এশিয়ান কালো ভাল্লুক অনেক কষ্টে এখনও টিকে আছে।
শ্লথ ভাল্লুক কালো রঙের হয়।দেহ লম্বা লোম দ্বারা আবৃত।তবে এদের দেহের কালো রঙের সাথে ধূসর একটা ভাব থাকে।বুকে সাদা বা ক্রিম রঙের V বা Y আকৃতির একটা চিহ্ন দেখা যায়।
এদের ওজন ৬০-১৪৫ কেজি।পুরুষদের তুলনায় স্ত্রীরা ৩০-৪০% ছোট হয়।বন্য অবস্থায় গড় আয়ু ১৬-২০ বছর।
এদের নখগুলো কাস্তে আকৃতির।লম্বায় প্রায় ৮-১০ সেমি হয়।
নখগুলো দেখতে অনেকটা ‘শ্লথ’ এর নখের মতো হওয়ায় এদেরকে শ্লথ ভাল্লুক নামে ডাকা হয়।
এরা মূলত নিশাচর প্রাণী।সারাদিন ঘুমায়,রাতে শিকার করে।
এদের দাঁত ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্যে মাংসাশী হলেও এদের প্রধান খাবার পিঁপড়া আর উইপোকা।সুযোগ পেলে শিকার করে মাংসও খায়।এছাড়া মধু,ফলমূল,গাছের লতাপাতাও খেয়ে থাকে।
শ্লথ ভাল্লুকেরা অন্যান্য ভাল্লুক থেকে কিছুটা আলাদা বৈশিষ্ট্যের।এরা হায়বারনেশন বা শীতনিদ্রা করেনা।
ঘ্রাণশক্তি অনেক প্রখর।যখন কোনো পিঁপড়ার ঢিবিতে বা মধুর চাকে হামলা করে তখন বিশেষ উপায়ে এদের নাকের ছিদ্রগুলো বন্ধ রাখতে পারে,যাতে কোনো পোকা নাকের মধ্যে না ঢুকতে না পারে।
চিরসবুজ পাহাড়ি বন,গুহাযুক্ত পাথুরে পাহাড়,তৃণভূমি এদের প্রধান আবাসস্থল।
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম,পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের বনভূমিতে এদের এককালে পাওয়া গেলেও বর্তমানে এদেশ থেকে বিলুপ্ত।
এটিই বাংলাদেশের বিলুপ্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো র সবচেয়ে নবীনতম বিলুপ্ত প্রাণী যার রেকর্ড ২০০০ সালের পর আর পাওয়া যায়নি।
শ্লথ ভাল্লুকের আবাসস্থল ধ্বংস করাই এদেশ থেকে এদের বিলুপ্তির প্রধান কারণ।বনভূমি উজাড় করার কারণে এদের চলাচলের পরিসর সীমিত হয়ে গেছে।ফলে ধীরে ধীরে এদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হলেও বর্তমানে ভারত,নেপাল,ভুটান,শ্রীলঙ্কাতে প্রায় ২০০০০ এর মতো শ্লথ ভাল্লুক টিকে আছে।