পৃথিবীর দীর্ঘতম দশটি নদী কোনগুলো!!
নদী হলো একটি প্রবাহিত জলরাশি যা উঁচু থেকে নিচু অঞ্চলে প্রবাহিত হয়।এটি সর্বদা একটি উৎস হতে উৎপত্তি হয়ে কোনো এক পতিতমুখে মিশে যায়।
একটি নদীর সঠিক দৈর্ঘ্য নির্ণয় করা যথেষ্ট কঠিন।এর জন্য প্রথমত প্রয়োজন এর পানির প্রকৃত উৎস ও পতিতমুখ শনাক্তকরণ।একটি নদীর অনেকগুলো পানির উৎস থাকতে পারে।
তবে পতিতমুখ থেকে যেটির অবস্থান সবচেয়ে দূরে,তাকেই উৎসমুখ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।এছাড়া এর উপনদীগুলোর দৈর্ঘ্যও নদীর দৈর্ঘ্যের সাথে যুক্ত করা হয়।
এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে নদী শুকিয়ে গেলে অথবা বর্ষাকালে নদীর দৈর্ঘ্য বেড়ে গেলেও নদীটির মূল চ্যানেলের দৈর্ঘ্য ও এর উপনদীগুলোর দৈর্ঘ্যের পরিমাপকেই নদীর মূল দৈর্ঘ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
চলুন আজ জেনে নেই বিশ্বের দীর্ঘতম দশটি নদী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য।
১.নীলঃ
বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম নদী নীলনদের আয়তন ৬৬৫০ কি.মি।লেক ভিক্টোরিয়া থেকে উৎপত্তি হয়ে এটি আফ্রিকা মহাদেশের ইথিওপিয়া,ইরিত্রিয়া,সুদান,উগান্ডা,তাঞ্জানিয়া,কেনিয়া,রুয়ান্ডা,বুরুন্ডি,মিশর,কঙ্গো,দক্ষিণ সুদান এই ১১ টি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভূমধ্যসাগরে পতিত হয়েছে।
নদীটির প্রতি সেকেন্ডে পানিপ্রবাহ গড়ে ২৮৩০ কিউসেক।এর অববাহিকার আয়তন ৩২,৫৪,৫৫৫ বর্গ কি.মি।
আফ্রিকার বিখ্যাত কিছু শহর,যেমন মিশরের কায়রো,সুদানের খার্তুম,দক্ষিণ সুদানের জুবা নীলনদের তীরেই অবস্থিত।
প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ মিশরীয় সভ্যতা নীলনদের তীরেই অবস্থিত।
নদীটিতে প্রায় ৮০০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়।
২.আমাজনঃ
দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশে অবস্থিত আমাজন পৃথিবীর ২য় দীর্ঘতম নদী।এর দৈর্ঘ্য ৬৪০০ কি.মি।
তবে পানিপ্রবাহ ও অববাহিকার আয়তনের দিক দিয়ে এটি বিশ্বের বৃহত্তম নদী।এর প্রতি সেকেন্ডে গড় পানিপ্রবাহ ২,০৯,০০০ কিউসেক এবং অববাহিকার আয়তন ৭০,৫০,০০০ বর্গ কি.মি।
নদীটি পেরুর আন্দিজ পর্বতমালার ‘নেভাদো মিস্মিফাউন্ড’ চূড়া থেকে উৎপত্তি লাভ করে পেরু,ব্রাজিল,বলিভিয়া,কলোম্বিয়া,ইকুয়েডর,ভেনিজুয়েলা এই ছয়টি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে পতিত হয়েছে।
নদীটি বিশ্বের বৃহত্তম রেইন ফরেস্ট আমাজনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এর পানিপ্রবাহ সর্বদাই বেশী থাকে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাপ এনাকোন্ডা ও হিংস্র পিরানহা মাছ,সরীসৃপ কেইমেন আমাজনেই পাওয়া যায়।ধারণা করা হয় নদীটিতে প্রায় ৪০০০-৫০০০ প্রজাতির মাছ আছে,যা প্রতিবছরই নতুন করে আবিষ্কৃত হচ্ছে।
৩.ইয়াংজিঃ
চীনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ইয়াংজি পৃথিবীর দীর্ঘতম দশটি নদী র মধ্যে তৃতীয় দীর্ঘতম নদী।এর দৈর্ঘ্য ৬৩০০ কি.মি।
এটি একক দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বিশ্বের দীর্ঘতম নদী।পানিপ্রবাহের দিক দিয়ে এটি বিশ্বের ৭ম বৃহত্তম নদী।এর প্রতি সেকেন্ডে গড় পানিপ্রবাহ ৩০,১৭০ কিউসেক।অববাহিকার আয়তন ১৮,০০,০০০ বর্গ কি.মি।
নদীটি তিব্বতের ট্যাঙ্গুলা পর্বত থেকে উৎপত্তি লাভ করে চীনের ৮ টি প্রদেশ ও দুইটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সাংহাইয়ের নিকট পূর্ব চীন সাগরে পতিত হয়েছে।
চীনের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ ইয়াংজি অববাহিকায় বাস করে।চীনের বৃহত্তম শহর সাংহাই এই নদীর তীরেই অবস্থিত।নদীটিতে বাঁধ দিয়ে নির্মান করা “থ্রি জর্জ ড্যাম’ বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
নদীটিতে প্রায় ৩৫০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়।
আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশের নদ-নদী সম্পর্কিত অজানা কিছু তথ্য।
৪.মিসিসিপিঃ
উত্তর আমেরিকা মহাদেশে অবস্থিত মিসিসিপি বিশ্বের ৪র্থ দীর্ঘতম নদী।এর দৈর্ঘ্য ৬২৭৫ কি.মি।
পানিপ্রবাহের দিক দিয়ে এটি ১৫ তম বৃহত্তম নদী।এর প্রতি সেকেন্ডে গড় পানিপ্রবাহ ১৬৮০০ কিউসেক।অববাহিকার আয়তন ২৯,৮০,০০০ বর্গ কি.মি।
নদীটি যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার লেক ইটাস্কা থেকে উৎপত্তি হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৩২ টি রাজ্য ও কানাডার ২ টি রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেক্সিকো উপসাগরে পতিত হয়েছে।
এটি উত্তর আমেরিকার একটি ব্যস্ততম নৌ রুট।যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার অর্থনীতিতে নদীটির বিশেষ অবদান রয়েছে।সাউথ লুইজিয়ানা,নিউ অর্লিয়েন্স বন্দর মিসিসিপির তীরেই অবস্থিত।
নদীটিতে প্রায় ২৬০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়।
৫.ইয়েনেসিঃ
ট্রান্স-সাইবেরিয়ান নদী ইয়েনেসি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম নদী।এর দৈর্ঘ্য ৫৫৩৯ কি.মি।
মঙ্গোলিয়ার মুনগারাগিয়ান-গোল পর্বত থেকে উৎপত্তি লাভ করে মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে প্রবাহিত হয়ে রাশিয়ার কারা সাগরে পতিত হয়েছে।
পানিপ্রবাহের দিক দিয়ে এটি বিশ্বের ১০ম বৃহত্তম নদী।পানিপ্রবাহ প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ১৯,৫০০ কিউসেক।অববাহিকার আয়তন ২৫,৮০,০০০ বর্গ কি.মি।
ইয়েনেসির গড় গভীরতা ৪৫ ফুট,তাই শীতের মৌসুম ব্যতিত সর্বদাই এর নাব্যতা বজায় থাকে।ইয়েনেসিতে অবস্থিত তিনটি পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র রাশিয়ার সিংহভাগ বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করে থাকে।
নদীটিতে প্রায় ৫৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়।
৬.ইয়োলোঃ
চীনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ইয়োলো রিভারের দৈর্ঘ্য ৫৪৬৪ কি.মি।হলুদাভ পানির রঙের কারণেই এই নদীর এরূপ নামকরণ করা হয়।
ইয়োলো রিভার প্রচুর পরিমাণ পলি পরিবহণ করে,এজন্য বেশীরভাগ সময়ই এর পানির রঙ হলুদ থাকে।নদীটি প্রায় ৩৪ কেজি/কিউসেক পরিমাণ পলি পরিবহণ করে সমু্দ্রে ফেলে,যা পলি পরিবহণের দিক দিয়ে বিশ্বে প্রথম।
কিংহাই রাজ্যের বায়ান হার পর্বত থেকে উৎপত্তি লাভ করে চীনের ৯ টি রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নদীটি ডংইং রাজ্যের বোহাই সাগরে পতিত হয়েছে।
এটির প্রতি সেকেন্ডে গড় পানিপ্রবাহ ২৫৭১ কিউসেক।অববাহিকার আয়তন ৭,৪৫,০০০ বর্গ কি.মি।
এটি হোয়াংহো নদী নামেও পরিচিত।উত্তর চীনের অর্থনীতি উন্নয়নের অন্যতম অন্তরায় নদীটি।প্রতিবছরই বন্যার কারণে চীনের ব্যপক অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধন করে নদীটি।এজন্য একে চীনের দুঃখ বলা হয়।
ইয়োলো রিভারে প্রায় ১৬০ ধরনের মাছ পাওয়া যায়,যারমধ্যে ১৯ টি প্রজাতিই এন্ডেমিক।
৭.ওবিঃ
এশিয়া মহাদেশে অবস্থিত ওবি পৃথিবীর দীর্ঘতম দশটি নদী র মধ্যে ৭ম বৃহত্তম।এর দৈর্ঘ্য ৫৪১০ কি.মি।
বিয়া ও কাতুন নদীর সংযোগস্থল থেকে উৎপত্তি লাভ করে রাশিয়া,কাজাখস্তান,চীন ও মঙ্গোলিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কারা সাগরে পতিত হয়েছে।
এর প্রতি সেকেন্ডে গড় পানিপ্রবাহ ১২,৪৮০ কিউসেক।অববাহিকার দৈর্ঘ্য ২৯,৯০,০০০ বর্গ কি.মি।
পশ্চিম সাইবেরিয়া সমভূমির ৮৫% ই ওব অববাহিকায় অবস্থিত।সাইবেরিয়ার বেশীরভাগ আমদানি-রপ্তানি ওব অববাহিকার মাধ্যমে হয়ে থাকে।নদীটিতে মাত্র ১৮০-২০০ দিন নাব্যতা থাকে,বাকি সময়গুলোতে বরফ দ্বারা আচ্ছন্ন থাকে।
ওবি অববাহিকায় প্রায় ৫০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়,যার মধ্যে ‘স্টার্জেন’ অন্যতম।
আরও পড়ুনঃ বিশ্বের বৃহত্তম,ক্ষুদ্রতম,দীর্ঘতম,উচ্চতম যতকিছু।
৮.পারানাঃ
বিশ্বের ৮ম দীর্ঘতম নদী পারানার দৈর্ঘ্য ৪৮৮০ কিমি।
ব্রাজিলের নিকট গ্রান্ডে ও পারাবাইনা নদীর সংযোগস্থল থেকে উৎপত্তি হয়ে ব্রাজিল,আর্জেন্টিনা,প্যারাগুয়ে,উরুগুয়ে ও বলিভিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পরবর্তীতে প্যারাগুয়ে নদী ও সর্বশেষ উরুগুয়ে নদীর সাথে সংযুক্ত হয়ে লা-প্লাটা অববাহিকা গঠন করে আটলান্টিক মহাসাগরে পতিত হয়েছে।
প্রতি সেকেন্ডে এর গড় পানিপ্রবাহ ১৭,২৯৩ কিউসেক।অববাহিকার দৈর্ঘ্য ২৫,৮২,৬৭২ বর্গকিমি।
নদীটি দক্ষিণ আমেরিকার বিশেষত আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়ের কৃষিপণ্য ও পেট্রোলিয়াম পরিবহণে বিশেষ অবদান রাখে।ব্রাজিল-প্যারাগুয়ে সীমান্তে পারানার উপর অবস্থিত ‘ইটাপু’ পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশ্বের ২য় বৃহত্তম।
৯.কঙ্গোঃ
আফ্রিকা মহাদেশের ২য় দীর্ঘতম নদী কঙ্গো বিশ্বের ৯ম দীর্ঘতম নদী।দৈর্ঘ্য ৪৭০০ কিমি।
এটি ডিআর কঙ্গোর লুয়ালুবা নদী থেকে উৎপত্তি লাভ করে ডিআর কঙ্গো,সেন্ট্রাল আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র,অ্যাঙ্গোলা,রিপাবলিক কঙ্গো,তাঞ্জানিয়া,ক্যামেরুন,জাম্বিয়া,বুরুন্ডি,রুয়ান্ডা এই নয়টি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে পতিত হয়েছে।
কঙ্গো পূর্বে জায়ারে নদী নামে পরিচিত ছিলো।এটি বিশ্বের সবচেয়ে গভীরতম নদীও বটে।এর গড় গভীরতা ৭০০ ফুটের কাছাকাছি।
পানিপ্রবাহের দিক দিয়ে এটি বিশ্বের ২য় বৃহত্তম নদী।প্রতি সেকেন্ডে গড় পানিপ্রবাহ ৪১,২০০ কিউসেক।
অববাহিকার আয়তনের দিক দিয়েও এটি বিশ্বের ২য় বৃহত্তম,যার আয়তন ৩৬,৮০,০০০ বর্গকিমি।এটি বিশ্বের ২য় বৃহত্তম রেইনফরেস্ট কঙ্গোর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত।
কঙ্গো বিশ্বের একমাত্র প্রধান নদী যা নিরক্ষরেখার উত্তর ও দক্ষিণ দুইদিক দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে।এজন্য নদীর একপাশে সর্বদা বর্ষাকাল থাকে,তাই পানিপ্রবাহও বেশী থাকে।কঙ্গো অববাহিকা আফ্রিকার ব্যস্ততম নৌপথের একটি।
নদীটিতে প্রায় ৭০০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়।
১০.আমুরঃ
বিশ্বের দশম দীর্ঘতম নদী আমুরের দৈর্ঘ্য ৪৪৮০ কিমি।এটি রাশিয়ার পোকরোভকার কাছে আর্গুন ও শিলকা নদীর মিলনস্থল থেকে উৎপত্তি লাভ করে রাশিয়া,চীন ও মঙ্গোলিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পুণরায় রাশিয়ার ওখস্টক সাগরে পতিত হয়েছে।
আমুর চীনে ‘হেইলং জিয়াং’ ও মঙ্গোলিয়াতে ‘খারামুরেন’ নামে পরিচিত।
এটির প্রতি সেকেন্ডে গড় পানিপ্রবাহ ১০,৯০০ কিউসেক।অববাহিকার আয়তন ১৮,৫৫,০০০ বর্গমিটার।
আমুর বিশ্বের অন্যতম মুক্ত প্রবাহমান নদী,যাতে কোনো বাঁধ নেই।নদীটি বেশীরভাগ সময় বরফে ঢাকা থাকে,মোটামুটি ১২০-১৩০ দিন নৌযান চলাচলের উপযোগী থাকে।
নদীটিতে প্রায় ১২৩ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়।
তথ্যসূত্রঃ
১.https://www.wikipedia.org/
২.https://www.britannica.com/
৩.https://www.assignmentpoint.com/other/top-10-longest-rivers-of-the-world.html
৪.https://largest.org/nature/rivers/
৫.https://safarisafricana.com/worlds-longest-rivers/
৬.https://www.wonderslist.com/top-10-largest-rivers/