কাপ্তাই লেকঃ অপরুপ সৌন্দর্যের আড়ালে থাকা এক কালো ইতিহাস!!

কাপ্তাই লেক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মানবসৃষ্ট হ্রদ।রাঙ্গামাটি জেলায় অবস্থিত হ্রদটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরুপ লীলাভুমি।চারপাশে সবুজ পাহাড়, ঝর্ণা ও উপত্যকা দ্বারা বেষ্টিত হ্রদটির মধ্যে ১০০টিরও বেশি ছোট-বড় দ্বীপ রয়েছে,যা এর বৈচিত্র্যতাকে আরও বৃদ্ধি করেছে।তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি হ্রদটির রয়েছে কিছু কালো অধ্যায়।আজ সেখান থেকে কিছুটা জানার চেষ্টা করবো।

ভৌগলিক অবস্থানঃ

কাপ্তাই লেক বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের রাঙ্গামাটি জেলার সদর,কাপ্তাই,নান্নেরচর,লংগদু,বাঘাইছড়ি,জুরাইছড়ি,বিলাইছড়ি ও বরকল উপজেলা জুড়ে বিস্তৃত।

হ্রদটির আয়তন ৬৮৮ বর্গ কি.মি।তবে বর্ষাকালে হ্রদটির আয়তন আরও বেড়ে যায়।গড় গভীরতা ১০০ ফুট বা ৩০ মিটার,সর্বোচ্চ গভীরতা ৪৯০ ফুট বা ১৫০ মিটার।

হ্রদটির উৎপত্তির ইতিহাসঃ

কাপ্তাই বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কৃত্রিম হ্রদ যা মানবসৃষ্ট।কর্ণফুলি নদীর উপর বাঁধ দেওয়ার ফলে হ্রদটির সৃষ্টি হয়েছে।

ভারতের মিজোরামের লুসাই পাহাড় থেকে উৎপত্তি লাভ করে রাঙ্গামাটি,খাগড়াছড়ি,বান্দরবন ও চট্টগ্রাম জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।

কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯০৬ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে। ১৯২৩ সালে চালানো হয় জরিপ এবং বাঁধ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখা হয়।

১৯৪৬ সালে পূর্ব বাংলায় নিযুক্ত ব্রিটিশ প্রকৌশলী ই.এ. মুর কাপ্তাইয়ের ৪০ মিটার উজানে ‘বরকল’ উপজেলাতে বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

তবে ১৯৫১ সালে প্রকৌশলী খাজা আজিমউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি দল বাঁধের স্থানটি চুড়ান্ত করে।

এতে আর্থিকভাবে সহায়তা করে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহযোগীতা সংস্থা USAID.

বাঁধটির দৈর্ঘ্য ৬৭০.৮ মিটার,উচ্চতা ৫৪.৭ মিটার।বাঁধের গেটসংখ্যা ১৬ টি।পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি প্রায় ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার বাঁধটির জন্য জলাধার নির্মাণ কাজ শুরু করে।

এ প্রকল্পে গবেষণার জন্য আন্তর্জাতিক প্রকৌশল সংস্থা আইইসিও এবং ঠিকাদার হিসেবে উটাহ ইন্টারন্যাশনাল ইনকর্পোরেটেড যুক্ত ছিলো।

১৯৬২ সালে বাঁধটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়।ফলে কর্ণফুলী নদীর মূল গতিপথ বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে এর উজানে থাকা নিম্নভূমি ও সমভূমি প্লাবিত হয়ে কাপ্তাই সৃষ্টি হয়।

কাপ্তাই বাঁধের প্রভাবঃ

হ্রদ সৃষ্টির ফলে রাঙ্গামাটির মোট মৌজার প্রায় ১২৫ টি পানিতে প্লাবিত,যার আয়তন ৬৮৮ বর্গ কি.মি।

এরমধ্যে প্রায় ৫৪০০০ একর বা ২২০ বর্গকি.মি এলাকার কৃষিজমি পানিতে ডুবে যায়,যা রাঙ্গামাটির মোট কৃষিজমির শতকরা ৪০% ছিলো।

হ্রদ সৃষ্টির ফলে এ অঞ্চলে থাকা প্রায় ১৮ হাজার পরিবারকে স্থানান্তরিত করা হয়।

ফলে প্রায় ১ লক্ষ উপজাতি বাস্তুচ্যুত হয়।এদের মধ্যে প্রায় ৭০% ই ছিলো চাকমা সম্প্রদায়ের।

হ্রদের থেকে চাকমা রাজার প্রাসাদও রক্ষা পায়নি।এটিও হ্রদের পানিতে প্লাবিত হয়।যা বর্তমানে প্রায় ১০ মিটার পানির নিচে তলিয়ে আছে।

আরও পড়ুনঃ ঢাকার বিভিন্ন এলাকার নামকরণের ইতিহাস।।

ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়াঃ

বাঁধ নির্মাণের সময় সরকার ক্ষতিগ্রস্থ উপজাতি সম্প্রদায়কে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো যে এই প্রকল্পে তাদের অনেকের চাকুরি দেওয়া হবে এবং বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সরবারহ করা হবে।তবে অনেকেই সে সুবিধা পায়নি।

এছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে অর্থ ও জমি দেওয়ার কথা ছিলো। কিছু পরিবার এ সুবিধা পেলেও অভিযোগ রয়েছে তাদের অনেকেই তা পায়নি।

১৯৮০ সালে ফার ইস্টার্ন ইকোনোমিক রিভিউয়ের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে,প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৩১ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছিলো।তবে মাত্র ২.৬ মিলিয়ন ডলার তাদের জন্য ব্যয় করা হয়।

প্রাথমিক পর্যায়ে বাস্তুচ্যুতদের লংগদু,বাঘাইছড়ি,বরকল এলাকার কিছু পাহাড়ের পাদদেশে পুনর্বাসিত করা হয়।

তবে কিছুদিনের মধ্যে হ্রদের পানিতে সে অঞ্চলগুলোও প্লাবিত হয়।

ফলে ১৯৬৫-৫৫ সাল নাগাদ ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৩৫-৪০ হাজার উপজাতি জনগোষ্ঠী বাংলাদেশ ছেড়ে মিয়ানমার ও উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা,মিজোরাম,মনিপুর,আসাম,অরুণাচল প্রদেশে গিয়ে আশ্রয়গ্রহণ করে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর সৃষ্টিঃ

১৯৬৩ সালে উপজাতীয় নেতা মনোবেনরো নারাইয়ন লারমা ক্ষতিগ্রস্ত উপজাতিদের নিয়ে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের দাবিতে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে তাকে গ্রেফতার করা হয়।১৯৬৫ সালে তিনি ছাড়া পান।

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তার নেতৃত্বে পার্বত্য অঞ্চলে উপজাতিদের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে জনসংহতি সমিতি বা শান্তিবাহিনী গঠিত হয়।

তবে ক্রমেই তারা তাদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে সন্ত্রাস,চাঁদাবাজি আর অপহরণের পথ বেছে নেয়।তাদের হাত থেকে পাহাড়ি উপজাতি বা বাঙালি কেউই রক্ষা পায়নি।

প্রায় কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সাথে সংঘাতের পর ১৯৯৭ সালে সরকারের মধ্যস্ততায় তারা একটি শান্তিচুক্তি সম্পন্ন করে।

জীববৈচিত্র্যের উপর বাঁধের প্রভাবঃ

বাঁধের কারণে কর্ণফুলী,চেঙ্গী,কাসালং,মাইনি উপত্যকার পার্বত্য ট্রপিক্যাল রেইনফরেস্ট বনের একটা বড় অংশ পানির নিচে তলিয়ে যায়।এরমধ্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চলও ছিলো।

একসময় পার্বত্য এসব বনাঞ্চল অনেক বিরল বন্যপ্রাণীতে পরিপূর্ণ ছিলো।

এর মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার,চিতাবাঘ,হাতি,ময়ুর,ভাল্লুক,বাইসন,হরিণ উল্লেখযোগ্য।কিন্তু হ্রদের কারণে বর্তমানে বেশীরভাগ বন্যপ্রাণীই স্থানান্তরিত হয়ে গেছে।

বর্তমানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার এ অঞ্চল থেকে পুরোপুরি এবং চিতাবাঘ প্রায় বিলুপ্তির পথে।হাতির সংখ্যাও ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।

কাপ্তাই হ্রদের অর্থনৈতিক গুরুত্বঃ

অর্থনৈতিকভাবে কাপ্তাই লেক গুরুত্বপূর্ণ।কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রায় ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে।

জলবিদ্যুতের মাধ্যমে সবচেয়ে কম খরচে উৎপাদন করা যায়।ফলে কম খরচে এটি চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে সম্ভব হচ্ছে।

বাঁধের কারণে কর্ণফুলি নদীর পানিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে,যা পার্বত্য চট্টগ্রামে ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন্যা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখছে।

কাপ্তাই হ্রদ রাঙ্গামাটি সদর,বিলাইছড়ি,বাঘাইছড়ি,জুরাইছড়ি,নান্নেরচর,কাপ্তাই,লংগদু,বরকল উপজেলার মধ্যে দীর্ঘ জলপথের সৃষ্টি করেছে।পূর্বে যসব দুর্গম এলাকাতে পৌঁছাতে দুই-তিনদিন সময় লাগতো,বর্তমানে তা জলপথের মাধ্যমে কয়েক ঘন্টায় পার হওয়া যায়।

এছাড়া কাপ্তাই বর্তমানে একটি পর্যটন হটস্পট।ফলে এটি স্থানীয় উপজাতি ও বাঙালিদের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি করেছে।

কাপ্তাই হ্রদে প্রায় ৪৯-৭১ প্রজাতির দেশীয় ও ৫ প্রজাতির বিদেশী মাছ পাওয়া যায়।

এর বার্ষিক প্রায় ৮৯৮০ মেট্রিক টন মিঠা পানির মাছ উৎপাদন করে।

পড়তে পারেনঃ ৪৭ এর দেশভাগঃ বাংলা ভাগ হয়েছিল যেভাবে।।

Back To Top