মানুষের রাষ্ট্র সৃষ্টির ধারণার পর থেকে বিশ্বের মানচিত্র বহুবার পরিবর্তিত হয়েছে।প্রতি শতাব্দীতেই সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন সব রাষ্ট্র।তবে কোনো রাষ্ট্রের এই রাজ্য পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অনেকেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।কোনো জাতি অন্য জাতি হতে স্বতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছে,আবার অনেকে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে পরস্পরের থেকে আলাদা হয়ে গেছে। বিশ্বের নতুন স্বাধীন দেশগুলো কারা?
জাতিসংঘের সর্বশেষ তথ্যানুসারে,বিশ্বের বর্তমান স্বাধীন রাষ্ট্রের সংখ্যা ১৯৫ টি।একবিংশ শতাব্দীতেও এখন পর্যন্ত ৫ টি দেশ স্বাধীন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
চলুন জেনে নেই,একুশশতকে স্বাধীন হওয়া দেশগুলো সম্পর্কে।
১.পূর্ব তিমুরঃ
একবিংশ শতাব্দীর প্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হলো পূর্ব তিমুর।এটি ২০ শে মে ২০০২ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
এটি সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই পর্তুগালের একটি উপনিবেশ ছিলো।২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি একবার জাপানের দখলে যায়।পরবর্তীতে এটি আবার পর্তুগীজদের দখলে যায়।
১৯৭৫ সালে পর্তুগীজরা উপনিবেশটি ছেড়ে চলে গেলে মূলত তৈরি হয় দ্বন্দ।
১৯৭৫ সালে পূর্ব তিমুরের একটি রাজনৈতিক দল দেশটিকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘পূর্ব তিমুর বিপ্লবী ফ্রন্ট’ গঠন করে এবং অঞ্চলটিকে স্বাধীন-সার্বভৌম অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে।
কিন্তু ইন্দোনেশিয়াও অঞ্চলটিকে তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দাবি করে।ফলে তৈরি হয় সংঘাত।ইন্দোনেশিয়া অঞ্চলটিকে আক্রমণ করে এবং দখল করে।
দীর্ঘ ২৫ বছর ইন্দোনেশীয়ান দখলদারিদের সাথে সংঘাতে ও দূর্ভিক্ষ-মহামারিতে দেশটির প্রায় ১.৫ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়।
আন্তর্জানিক চাপের মুখে ইন্দোনেশিয়া ১৯৯৯ সালে পূর্ব তিমুরে গণভোট দিতে বাধ্য হয়।এতে দেশটির ৪/৫ অংশ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেয়।
পরে এটি জাতিসংঘের তত্বাবধায়নে স্ব-শাসিত অঞ্চল ছিলো।২০০২ সালে এটি ইন্দোনেশিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে
২.সার্বিয়াঃ
বিশ্বের নতুন স্বাধীন দেশগুলো র মধ্যে সার্বিয়া অন্যতম।সাবেক যুগোস্লাভিয়ার প্রাণকেন্দ্র সার্বিয়া ২০০৬ সালে স্বাধীনতা লাভ করে।
বলকান অঞ্চলের এই দেশটি দীর্ঘকাল অটোম্যান সাম্রাজ্য ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিলো।
২০০৩ সাল পর্যন্ত এর নাম ছিলো সার্বিয়া-মন্টেনিগ্রো।২০০৬ সালে মন্টেনিগ্রো বেরিয়ে যাওয়ায় এটি স্বাধীন সার্বিয়া হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
১৯১৮ সালে ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর সার্বিয়া,বসনিয়া,হারজেগোভিনা,মেসিডোনিয়া,ক্রোয়েশিয়া ও স্লোভেনিয়া মিলে যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশন গঠন করে।
এদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো অটোম্যান সাম্রাজ্য,অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সামাজ্য,গ্রীস,বুলগেরিয়ার আক্রমণ থেকে দেশগুলোকে রক্ষা করা।এর রাজধানী ছিলো বেলগ্রেড,যা বর্তমান সার্বিয়ার রাজধানী।
১ম বিশ্বযুদ্ধের পর সার্বিয়ার দখল করা আলবেনিয় অঞ্চলটুকু কসোভো হিসেবে যুগোস্লাভিয়ার অংশ হয়।
তৎকালীন সময়ে যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশন একটি শক্তিশালী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
তবে ১৯৯১ সালে স্লোভেনিয়া,ক্রোয়েশিয়া ও মেসিডোনিয়া এবং ১৯৯২ সালে বসনিয়া ও হারজেগোভিনা ফেডারেশন থেকে বের হয়ে গেলে যুগোস্লাভিয়া কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
১৯৯২ সালে মন্টেনিগ্রো সার্বিয়ার সাথে জোটবদ্ধ হয়ে যুগোশ্লাভিয়াকে টিকিয়ে রাখে।
তবে গণভোটের মাধ্যমে ২০০৬ সালে মন্টেনিগ্রো ফেডারেশন থেকে বের হয়ে গেলে এটি স্বাধীন সার্বিয়া হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
এরপর ২০০৮ সালে কসোভো সার্বিয়া থেকে বের হয়ে গেলে বর্তমান সার্বিয়া অংশটুকু স্বাধীন সার্বিয়া হিসেবে বিশ্ব দরবারে পরিচিত।
সাবেক যুগোস্লাভিয়া ভাঙার কারণ হিসেবে অন্যান্য ফেডারেল দেশগুলো সার্বিয়ানদের উগ্রতাকে দায়ী করেছে।
আরও পড়ুনঃ বিশ্বের দীর্ঘতম দশটি নদীর তালিকা।
৩.মন্টেনিগ্রোঃ
সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার অংশ মন্টেনিগ্রো বলকান অঞ্চলের ছোট একটি দেশ।
১৯৮৯ সালে যুগোশ্লাভিয়ার বিভক্তির পর এটি ১৯৯২ সালে একটি স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে সার্বিয়ার সাথে সার্বিয়া-মন্টেনিগ্রো হিসেবে জোটবদ্ধ হয়।
তবে জোটে দেশটির অবদান তুলনামূলক নগন্য ছিলো।এটি আয়তনে সার্বিয়ার তুলনায় অনেক ছোট ছিলো।জনসংখ্যার অনুপাত আর টোটাল জিডিপিতে এর অবদানও ছিলো অতি সামান্য।
ফলে ক্ষমতার অগ্রাধিকার ও প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক চাহিদার অভাবে মন্টেনিগ্রোয়ানরা হতাশ হয়ে পড়ে।
১৯৯৯ সালে এরা সার্বিয়ানদের সাথে ফেডারেশন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য গণভোটের পরিকল্পনা করে।
২০০৩ সালে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়।এতে ৫৫.৫% মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেয়।
২০০৬ সালে সার্বিয়া-মন্টেনিগ্রো ফেডারেশন ভেঙে সার্বিয়া ও মন্টেনিগ্রো নামের দুইটি আলাদা স্বাধীন দেশ বিশ্ব মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে।
৪.কসোভোঃ
প্রাক্তন যুগোশ্লাভিয়ার অংশ কসোভো ১৭ ফেব্রুয়ারি,২০০৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে।
মূলত সার্বিয়া ১ম বিশ্বযুদ্ধের সময় আলবেনিয়ার যে অঞ্চলটুকু নিজেদের দখলে নেয়,সেই অঞ্চলটিই হল কসোভো।২য় বিশ্বযুদ্ধের পর কসোভোকে একটি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
১৯৮১ সালে কসোভোর আলবেনীয়রা অঞ্চলটিকে পূর্ণ প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা দেওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করে।
১৯৮৯ সালে সার্বিয়ান নেতা স্লোভোডান মিনোসেভিচ যুগোশ্লাভিয়ার ক্ষমতা অর্জন করে এবং কসোভোর সায়ত্বশাসন তুলে দিয়ে সরাসরি শাসন জারি করে।
১৯৯০ সালে কসোভোর আলবেনীয়রা শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের চেষ্টা করতে কসোভো নিবারেশন আর্মি(KLA) গঠন করে।
কিন্তু KLA সার্বিয়ান আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হলে ১৯৯৬ সালে আলবেনীয় গেরিলা সংস্থা গঠন করে।
১৯৯৯ সালে মিলোসেভিচ এদেরকে চিরতরে দমন করতে পুলিশ ও সেনাবাহিনী দ্বারা কসোভোতে এক নারকীয় হত্যাকান্ড চালায় সাধারণ জনগণ আর আলবেনীয় গেরিলা সংস্থার বিরুদ্ধে।৭৮ দিন ধরে চলে এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ।
বিশ্বব্যপী এই হত্যাকান্ডের ব্যপক নিন্দা হলে NATO এই সহিংসতা বন্ধে এগিয়ে আসে।
এরপর কসোভোকে জাতিসংঘের প্রশাসনের অধীনে রাখা হয়।
এরপর স্বাধীনতার জন্য সার্বিয়ান ও কসোভোর নেতাদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়।
২০০৮ সালে কসোভো সার্বিয়া থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা করে।তবে সার্বিয়া তা প্রত্যাখ্যান করে।
পরবর্তীতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন,যুক্তরাষ্ট্র,কানাডা,জাপান সহ আরও অনেক আন্তর্জাতিক শক্তি কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়।
বর্তমানে কসোভো বিশ্বে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে পরিচিত।
৫.দক্ষিণ সুদানঃ
উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার দেশ সুদান সবচেয়ে নবীণতম দেশ। বিশ্বের নতুন স্বাধীন দেশগুলো র মধ্যে এটিই সর্বশেষ।এটি সুদান থেকে ৯জুলাই,২০১১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে।
দেশটির আয়তন ৬,১৯,৭৪৫ বর্গ কি.মি।রাজধানী শহর জুবা।সুদানের দক্ষিণের ১০ টি রাজ্য নিয়ে দেশটি গঠিত।
এটিকে আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় দেশ হিসেবে বিবেচিত করা হয়,যেখানে ৬০ টিরও বেশী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বাস করে।দেশটি ক্রান্তিয় বন,জলাভূমি আর তৃণভূমিতে আচ্ছাদিত।
প্রায় এক দশকের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে।মূলত সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বৈষম্যই দুই সুদানের বিভাজনের মূল কারণ।
দক্ষিণ সুদানের বেশীরভাগ জনসংখ্যাই খ্রিষ্টান আর নাস্তিক।এরা মূলত আফ্রিকান সংস্কৃতি দ্বারা গঠিত।
অপরদিকে সুদানের বেশীরভাগ জনসংখ্যাই মুসলিম।এরা জাতিগতভাবে আরব সংস্কৃতির অন্তর্গত।
আরও পড়ুনঃ বিশ্বের সবচেয়ে বড় দশটি শহর।
দেশভাগের পরও মুদ্রা,বানিজ্য,তেল ভাগাভাগি,সীমান্ত জটিলতা নিয়ে দুদেশের মধ্যে উত্তেজনা এখনো চরমে।
এর সাথে দক্ষিণ সুুদান নিজেদের মধ্যে জাতিগত সহিংসতায় এবং বিদ্রোহী তৎপরতায় জর্জরিত।