বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে যে স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো।।পর্ব-২

স্তন্যপায়ী প্রাণী

বাংলাদেশ।আয়তনে ছোট্ট একটি দেশ।বনভূমির পরিমাণও খুবই কম।বিগত ১০০ বছরে দেশে অতিরিক্ত বনভূমি না থাকলেও যা ছিলো তো যথেষ্ট পরিমাণে।তখন জীববৈচিত্র্যেও ভরপুর ছিলো এই দেশ।তবে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যই আমরা হারিয়েছি তাদেরকে।হারাতে চলেছি আরও কিছু প্রাণীকেও।ক্রমাগত জনসংখ্যার চাপ সামাল দিতে কৃষিজমি ও বাসস্থানের জন্য নির্বিচারে আমরা বন উজাড় করেছি।ডেকে এনেছি পরিবেশের বিপর্যয়,তেমনি ধ্বংস করেছি প্রাণীদের আবাসস্থল।নির্বিচারে হত্যা করেছি তাদেরকে।ফলে,অনেক প্রাণীই এদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে,কিছু বিলুপ্তির পথে।

বাংলাদেশ বন বিভাগ ও আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (IUCN) বাংলাদেশের ১৬১৯ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর বর্তমান অবস্থা নিয়ে ২০১৪-১৫ সালে একটি সমীক্ষা চালিয়েছে।বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা প্রাণীগুলোকে লালতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী,বিগত ১০০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৩১ টি বন্যপ্রাণী সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।এরমধ্যে ১১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী,১৯ প্রজাতির পাখি ও একটি সরীসৃপ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

মহাবিপন্নের তালিকায় আছে ৫৬ টি প্রজাতি,বিপন্ন ১৮১ টি প্রজাতি ও ঝুঁকিতে আছে ১৫৩ টি প্রজাতি।ঝুঁকির কাছাকাছি আছে ৯০ টি প্রজাতি।পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত আছে ৮০২ টি প্রজাতি।পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায়নি ২৭৮ টি প্রজাতি সম্পর্কে,সংখ্যা নির্ধারণ করা যায়নি ২৮ টি প্রজাতির।তবে এরাও সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত।

বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হওয়া ৩১ টি প্রাণীর মধ্যে ১১টি স্তন্যপায়ী হলঃ ডোরাকাটা হায়েনা,ধূসর নেকড়ে,নীলগাই,বনগরু,সুমাত্রা গন্ডার,জাভা গন্ডার,ভারতীয় গন্ডার,জলার হরিণ,কৃষ্ণমৃগ,বুনোমোষ,শ্লথ ভাল্লুক।

তালিকায় ১৯ টি পাখিও আছে।এগুলো হলঃ লালমুখ দাগিডানা,বড় সারস,ধূসর মেটে তিতির,বাদা তিতির,বাদিহাঁস,গোলাপী হাঁস,বড় হাড়গিলা,ধলাপেট বক,সাদাফোঁটা গগণবেড়,রাজশকুন,দাগিবুক টিয়াঠুঁটি,লালমাথা টিয়াঠুঁটি,গাছআচড়া,সবুজ ময়ুর,বড় মদনটাক,বাংলা ডাহর,পাতি ডাহর,লাল বাটাই,দেশী ময়ুর।

তালিকার একমাত্র হতভাগা সরীসৃপ হলঃ মিঠাপানির কুমির।

প্রথম পর্বটি পড়তে ক্লিক করুনঃ বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে যে স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো।।পর্ব-১

প্রথম পর্বে আমরা বিলুপ্ত ১১ টি স্তন্যপায়ীর মধ্যে ৬ টি প্রাণী নিয়ে আলোচনা করেছি।এ পর্বে আমরা বাকি ৫ টি প্রাণী নিয়ে আলোচনা করবো।

বনগরু

৭.বনগরু বা বান্টেগঃ

গরুর বন্য প্রজাতিগুলোর মধ্যে বান্টেগই দেখতে সবচেয়ে আকর্ষণীয়।এগুলো দেখতে অনেকটা গৃহপালিত গরুর মতোই।

এদের পুরুষ ও স্ত্রী জাতিকে সহজেই আলাদা করা যায়।পুরুষদের গায়ের রঙ গাঢ় বাদামি বা নীলচে কালো।আর স্ত্রী প্রজাতির গায়ের রঙ হালকা বাদামি বা লালচে বাদামি।এদের পা থেকে হাঁটু পর্যন্ত মোজার মতো সাদা রঙের হয়ে থাকে।পেছনের অংশও সাদা।

শরীরের দৈর্ঘ্য ১.৯-২.২৫ মিটার,উচ্চতা ১.৫-১.৭ মিটার।লেজের দৈর্ঘ্য ৬৫-৭০ সেমি,আর শিং ৬০-৭৫ সেমি পর্যন্ত হয়ে থাকে।এদের গড় ওজন ৬০০-৮০০ কেজির মধ্যে হয়।গড় আয়ু ১৬-২০ বছর।

পুরুষ ও স্ত্রী উভয়েরই শিং থাকে,তবে স্ত্রীদের একটু ছোট থাকে।ওজনের তেমন তারতম্য হয়না।এরা বেশ শান্ত।দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি প্রখর।দীর্ঘদিন পানি না খেয়েও বাঁচতে পারে।
এরা পূর্বে দিন-রাত উভয় সময়েই চরে বেড়ালেও বর্তমানে মানুষকে এড়িয়ে চলতে নিশাচরে পরিণত হয়েছে।

বনগরুর দল

এরা দলবেঁধে চলাচল করে।প্রতিটি দলে ২-৪০ জন সদস্যও থাকতে পারে।শুধু একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষ বা স্ত্রীর নেতৃত্বে স্ত্রী ও কমবয়সীদের নিয়ে দল গঠন হয়।অন্যান্য পুরুষেরা ব্যাচেলর গ্রুপ গঠন করে,অথবা একাকী থাকে।

ঘাসই এদের প্রধান খাবার।এছাড়া গাছের পাতা,ছোট গুল্ম,বাঁশের পাতা ও এদের প্রিয় খাবার।এরা শক্ত ও কর্কশ ঘাস খাওয়ায় দাঁত দ্রুত ক্ষয় হয়।এই ক্ষয়রোধ করার জন্য প্রচুর পরিমাণে খনিজ খায়,এতে অন্ত্রের পোকাও দমন হয়।বনগরুর এই অভ্যাসের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে এদেরকে লবণের টোপ ফেলে ধরা হতো।

খোলা প্রান্তর,তৃণভূমি,চিরসবুজ বন,বাঁশের বাগান এদের প্রধান বিচরণক্ষেত্র ছিলো।

বাংলাদেশের চট্টগ্রাম,পার্বত্য চট্টগ্রাম আর সিলেটে বনে বনগরু পাওয়া যেতো।১৯৩০ সালের পর বাংলাদেশের কোথাও আর এদেরকে পাওয়া যায়নি।বর্তমানে এদেশ থেকে এরা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত।

বন উজাড়,ফসল রক্ষা আর মাংসের লোভে শিকার করাই এদেশ থেকে বনগরু বিলুপ্তির প্রধান কারণ।

ইন্দোনেশিয়া,থাইল্যান্ড,লাওস,মালয়েশিয়া,ভিয়েতনাম,কম্বোডিয়া,মায়ানমারে বর্তমানে ৫-৮ হাজারের মতো বনগরু টিকে আছে।

বুনো মহিষ

৮.বুনো মহিষঃ

বাংলাদেশে এককালে প্রায় সর্বত্রই বুনো মহিষ পাওয়া যেতো।স্থানীয়ভাবে একে বয়ারও বলা হতো।গৃহপালিত মহিষ আর বুনো মহিষের আকৃতগত পার্থক্য ছাড়া আর তেমন কোনো তফাৎ নেই।

বুনো মহিষ আকারে ভারী,দেহ বৃহৎ ও পাগুলো অনেক শক্ত।
এরা ছাই ধূসর বা কালো রঙের হয়ে থাকে।শিংয়ের রংও কালো।পুরুষ ও স্ত্রী উভয়ই শিং বহন করে।পুরুষদের শিং অর্ধচন্দ্রাকার ও বড়,স্ত্রীদের শিং সোজা ও ছোট হয়।

দেহের দৈর্ঘ্য ২.৪-৩ মিটার,উচ্চতা ১.৫-১.৯ মিটার।লেজের দৈর্ঘ্য ৬০-৮৫ সেমি।শিংয়ের গড় দৈর্ঘ্য ১-১.২ মিটার,যা ২ মিটার পর্যন্তও বাড়তে পারে।এদের ওজন ৭০০-১২০০ কেজি।গড় আয়ু ২৫ বছর।

এরা সকাল ও সন্ধ্যায় বেশী সক্রিয় থাকে।দিনের উত্তপ্ত সময়ে এরা জলাভূমির কাঁদাতে গড়াগড়ি করে।

বন মহিষের দল

এরাও দলবদ্ধ হয়ে চলাচল করে।একজন পূর্ণবয়স্ক স্ত্রীর নেতৃত্বে স্ত্রী ও কমবয়সীদের ১০-২০ জনের একটি দল একত্রে চরে বেড়ায়,মাঝে মাঝে দলে একজন পুরুষও থাকে।কমবয়সী মোষদের ৬-৮ জনের দলও একত্রে চরতে দেখা যায়।পুরুষেরা সাধারণত একাকীই চলে।

এরা ঘাস,ছোট গুল্ম,লতা-পাতা,জলজ উদ্ভিদ খায়।সুযোগ পেলে কৃষকের ফসলও সাবাড় করে ফেলে।

গীষ্মমন্ডলীয় বন,জলাভূমি, নদীর ধারের বন,ম্যানগ্রোভ বন এদের প্রধান বিচরণক্ষেত্র।

বাংলাদেশের একসময় প্রায় সর্বত্রই বুনো মহিষ পাওয়া যেতো।বিশেষত সুন্দরবন,বরিশাল,পার্বত্য চট্টগ্রাম,উত্তরবঙ্গ,ময়মনসিংহ,জামালপুর অঞ্চলে।
সুন্দবনের বয়ারডাঙ্গা,বয়ারগাতি,বয়ারশিঙ্গা এলাকা এদের পূর্বের অস্তিত্বেরই জানান দেয়।

IUCN এর তথ্যানুযায়ী ১৯৪০-৫০ দশকের কোনো এক সময়ে এটি এদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়।
মাংসের জন্য হত্যা,আবাসভূমি ধ্বংস,মহামারী ইত্যাদি এদের বিলুপ্তির প্রধান কারণ।

বর্তমানে এটি ভারত,নেপাল,ভুটান,কম্বোডিয়া,মায়ানমারে ২.৫-৪ হাজারের মতো আছে,যাদের অস্তিত্বও হুমকির মুখে।

পুরুষ নীলগাই

৯.নীলগাইঃ

নাম নীলগাই হলেও এদের রঙও নীল না,আর এরা গাই বা গরুজাতীয় কোনো প্রাণীও না।এদের মধ্যে অনেকগুলো প্রাণীর বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।নীলগাই এশিয়ার বৃহত্তম হরিণজাতীয় প্রাণী।দেখতে অনেকটা ঘোড়ার মতো।মাথা সরু ও লম্বা।পা গুলো ঘোড়ার মতোই শক্ত।পুরুষদের কাঁধে কেশরও থাকে।আবার গরুর মতো শিংও থাকে।

পুরুষ ও স্ত্রী নীলগাইকে সহজেই আলাদা করা যায় এদের গায়ের রং দেখে।পুরুষদের দেহ ধূসর থেকে নীলচে ধূসর রঙের হয়।স্ত্রীরা তামাটে,বাদামি বা হলদে বাদামি রঙের।পুরুষদের শিং থাকে,স্ত্রীদের সাধারণত থাকেনা।

এদের দেহের দৈর্ঘ্য ১.৮-২ মিটার,উচ্চতা ১.২-১.৫ মিটার।শিংয়ের দৈর্ঘ্য ১৫-২৫ সেমি,লেজের দৈর্ঘ্য ৪০-৪৫ সেমি।এদের ওজন ১২০-২৮০ কেজির মধ্যে হয়।গড় আয়ু ২১ বছর।
পুরুষেরা স্ত্রীদের থেকে বড় হয়।

স্ত্রী নীলগাই

এরা দিনে সক্রিয় থাকে।সকাল ও বিকালে খাবার খায়।দলবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করে।দলে সাধারণত ৪-১০ জন সদস্য থাকে।তবে এর থেকেও বড় দলে চরে বেড়াতে পারে।বয়স্ক পুরুষেরা একা থাকে।

নীলগাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন,কানও অনেক সজাগ,তবে ঘ্রাণশক্তি ততটা প্রখর নয়।এরা অত্যন্ত দ্রুতগামী,ঘন্টায় ৪৮ কিমি বেগেও চলতে পারে। সামনের পা পেছনের পা থেকে কিছুটা লম্বা।

এরা সাধারণত ঘাস,লতা-পাতা,ছোট গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ পছন্দ করে।কৃষকের ফসল খাওয়াতেও এরা ওস্তাদ।
ঝোপঝাড়ের বন,ঘাসের সমভূমি,কৃষিজমির আশেপাশ,খোলা প্রান্তর এদের পছন্দের বিচরণক্ষেত্র।ঘন জঙ্গল এদের কাছে অপছন্দনীয়।


বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও,দিনাজপুর,রংপুর,জয়পুরহাট,রাজশাহী অঞ্চলে একসময় নীলগাই পাওয়া যেতো।

১৯৪০ সালের পর আর বাংলাদেশে নীলগাই পাওয়া যায়নি।
মাংসের জন্য নির্বিচারে শিকার,আবাসস্থল ধ্বংস,ফসল রক্ষার অজুহাতে এদেরকে হত্যা ইত্যাদি কারণে বর্তমানে এটি দেশ থেকে বিলুপ্ত।

তবে ইদানিং দেশের অনেক জায়গায় নীলগাইয়ের দেখা মিলেছে।২০১৮৷ সালে ঠাঁকুরগাওয়ে,২০১৯ সালে নওগাঁয়,২০২০ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ,২০২১ সালে নওগাঁ ও ঠাকুরগাওয়ে নীল গাইয়ের সন্ধান মিলেছে।তবে প্রাণী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এগুলো ভারত থেকে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে।উদ্ধার হওয়া এসব নীলগাই দিয়ে বিজ্ঞানীরা বংশবিস্তারের চেষ্টা করছে।আশা করা যায়,খুব দ্রুতই বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত নীলগাই আবার নতুন করে ফিরে আসবে।

বর্তমানে ভারত,পাকিস্তান,নেপাল,যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১ লক্ষের মতো নীলগাই টিকে আছে।

পুরুষ বারসিঙ্গা

১০.জলার হরিণ/বারোসিঙ্গাঃ

ভারতীয় উপমহাদেশের জলা-জঙ্গলের আশেপাশে বাস করে বারসিঙ্গা।প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হরিণের শিংয়ে গড়ে ১২ টি শাখাযুক্ত থাকে।এজন্য এদেরকে বারোসিঙ্গা বলে।মূলত এদের শিংগুলো ১০-১৪ টি শাখাযুক্ত থাকে।

এদের শরীর কমলা বা বাদমি রঙের হয়ে থাকে।পুরুষেরা স্ত্রীদের থেকে আরও গাঢ় রঙের হয়ে থাকে।পায়ের ভেতরের অংশ ক্রিম রঙের হয়।এদের পাগুলো উঁচু,মাথা ছোট,তবে কানগুলো লম্বা।

দেহের দৈর্ঘ্য ১.২-১.৮ মিটার,উচ্চতা ১.১-১.২ মিটার।লেজের দৈর্ঘ্য ১২-২০ সেমি।শিংয়ের গড় দৈর্ঘ্য . ৯-১ মিটার হয়।শুধু পুরুষদেরই শিং থাকে,স্ত্রীদের থাকেনা।ওজন ১৩০-২৮০ কেজি হয়।গড় আয়ু বন্য অবস্থায় ২০ বছর।

স্ত্রী বারসিঙ্গার দল

এরা দিনে-রাতে সবসময়ই সক্রিয়।একজন স্ত্রীর নেতৃত্বে ১০-২০ জনের একটি দল চরে বেড়ায়।তবে প্রজনন মৌসুমে ৩০-৬০ জনের একটি বৃহৎ দল গঠিত হয়।প্রজনন মৌসুম ছাড়া অন্যসময় পুরুষেরা একাই চলে।

বারসিঙ্গা অত্যন্ত শান্ত,ভীতু ও সংবেদনশীল প্রাণী।ভয় পেলে বা বিরক্ত হলে এরা দৌড়ে পালায়।

এরা নিরামিষভোজী।ঘাস আর জলজ উদ্ভিদই এদের প্রধান খাদ্য।নদীর পাশে নিমজিত তৃণভূমি আর জলাভূমিই এদের প্রধান বিচরণক্ষেত্র।এরা বনেই থাকুক কিংবা মুক্ত প্রান্তরেই থাকুক,সবসময় পানির উৎসের আশেপাশেই থাকে।

একসময় গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় এদের ব্যাপক বিচরণ থাকলেও বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়।বাংলাদেশের হাওড় অঞ্চল, রংপুর,দিনাজপুর,সুন্দরবন,ময়মনসিংহ,নোয়াখালী,বরিশাল,চট্টগ্রাম,সিলেট অঞ্চলে এককালে বারসিঙ্গা দেখা যেতো।বর্তমানে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত।

সর্বশেষ এরা সুন্দরবনে টিকে ছিলো।কিন্তু ১৯৫৪ সালের বন্যার পর এদেরকে সুন্দরবন বা বাংলাদেশের আর কোথাও দেখা যায়নি।আবাসভূমি ধ্বংস,জলাভূমি কমে আসা,এদের বিচরণভূমিতে কৃষিকাজ,মাংসের জন্য হত্যা এদের দেশ থেকে বিলুপ্তির প্রধান কারণ।

তবে ভারত ও নেপালে ২৫০০ র মতো বারসিঙ্গা এখনও টিকে আছে।

প্রথম পর্বটি পড়তে ক্লিক করুনঃ বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে যে স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো।।পর্ব-১

পুরুষ কৃষ্ণমৃগ

১১.কৃষ্ণসারঃ

কৃষ্ণসার একটি ছোট হরিণজাতীয় প্রাণী।আকর্ষণীয় শরীরপর রঙ এদেরকে অন্য হরিণদের থেকে কিছুটা আলাদা করেছে।

পুরুষেরা গাঢ় বাদামি থেকে কালো রঙের হতে পারে।বছরের অন্য সময় এরা কিছুটা বিবর্ণ থাকলেও,প্রজনন মৌসুমে গায়ের রং গাঢ় হতে থাকে।স্ত্রীরা হলদে বাদামি থেকে তামাটে রঙের হয়।তবে উভয়েরই পেট,পায়ের ভেতরের অংশ ও চোখের রিং সাদা।শরীরের রঙের পার্থক্য দেখে সহজেই পুরুষ ও স্ত্রীকে আলাদা করা যায়।

কৃষ্ণসার ১-১.৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে,উচ্চতা ৭৪-৮৪ সেমি।লেজের দৈর্ঘ্য ১০-১৭ সেমি।শিংয়ের দৈর্ঘ্য ৩৫-৭৫ সেমি।এদের ওজন ২৫-৪৫ কেজির মধ্যে হয়।আয়ু ১০-১৫ বছর।
শুধুমাত্র পুরুষদের শিং থাকে।শিংটি “V” আকৃতির ও তাতে ৪-৫ টা প্যাঁচ থাকে।পুরুষ ও স্ত্রীদের শারীরিক পার্থক্য খুবই কম।

সাধারণত দিনেই সক্রিয় থাকে।সকাল ও বিকালে খাবার গ্রহণ করে।বাকিসময় ছায়াতে বিশ্রাম নেয়।

কৃষ্ণসার সামাজিকবাবে জীবণযাপন করে।একজন পুরুষের নেতৃত্বে অসংখ্য স্ত্রী ও তরুণ শিশুদের ৫-৫০ জনের একটি দল একত্রে চরে বেড়ায়।

একত্রে পুরুষ ও স্ত্রী কৃষ্ণমৃগ

এরা খুবই লাজুক ও সতর্ক প্রাণী।শ্রবণশক্তি ও ঘ্রাণশক্তি কিছুটা দূর্বল হলেও দৃষ্টিশক্তি অনেক প্রখর।বিপদে পড়লে শূন্যে লাফ দিয়ে দিয়ে দৌড়ে পালায়।এরা অত্যন্ত দ্রুতগতিসম্পন্ন।ঘন্টায় সর্বোচ্চ ৮০ কিমি বেগেও দৌঁড়াতে পারে।এরা গরম আবহাওয়া পছন্দ করে।

এদের প্রধান খাবার ঘাস।এছাড়া ছোট লতা,সপুষ্পক উদ্ভিদ,ফলমূলও এদের পছন্দ।

পত্রঝরা বন,ঘাসের ভূমি,হালকা চিরসবুজ বনাঞ্চল এদের পছন্দের বিচরণভূমি।

এরা প্রতিদিন প্রচুর পানি পান করে,তাই পানির উৎসের আশেপাশেই থাকে।

বাংলাদেশের রাজশাহী,রংপুর,দিনাজপুর অঞ্চল ও খুলনা বিভাগের কিছু কিছু এলাকায় একসময় কৃষ্ণসার হরিণ পাওয়া যেতো,বলে মত দিয়েছেন কিছু বিজ্ঞানীরা।বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে পুরোপুরি বিলুপ্ত।

আবাসস্থল ধ্বংস,ফসল রক্ষা,মাংস,চামড়া ও শিংয়ের জন্য অতিরিক্ত শিকার এদের বিলুপ্তির প্রধান কারণ।
ধারণা করা হয় ১৯ শতকের শেষ বা বিংশ শতাব্দীর শুরুর নাগাদ কৃষ্ণসার বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

বর্তমানে ভারত,নেপাল,পাকিস্তান,যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস,আর্জিন্টিনায় ৫০ হাজারের মতো কৃষ্ণসার টিকে আছে।

বন্যপ্রাণী আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ।আমাদের মতো তাদেরও এই পৃথিবীতে বাস করার অধিকার আছে।তাই বিনা কারণে এদেরকে হত্যা না করি।কোনো বন্যপ্রাণী মানুষের কাছাকাছি কিংবা বাসস্থানের আশেপাশে চলে আসলে এদেরকে হত্যা না করে নিকটস্থ বনবিভাগ বা জাতীয় জরুরি নম্বর ৯৯৯ এ কল দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন।

তথ্যসূত্রঃ
১.https://www.wikipedia.org
২.https://www.iucn.org
৩.https://animaldiversity.org/accounts/Rucervus_duvaucelii/
৪.https://www.theanimalfacts.com/mammals/banteng/
৫.https://animaldiversity.org/accounts/Bos_javanicus/
৬.http://www.ultimateungulate.com/Artiodactyla/Bubalus_arnee.html
৭.https://books.google.com.bd/books?id=XAX0bqw-I2oC&pg=PA118&lpg=PA118&dq=bubalus+arnee+average+horn+size&source=bl&ots=K-9A8fky0r&sig=ACfU3U0gxbGMMEKJgZ8d9cDr6k5hB8CtEQ&hl=en&sa=X&ved=2ahUKEwj00_nRovfwAhVZqksFHSBVBTkQ6AEwFnoECBwQAg#v=onepage&q=bubalus%20arnee%20average%20horn%20size&f=false
৮.https://www.softschools.com/facts/animals/nilgai_facts/242/#:~:text=Nilgai%20is%20large%20animal.,the%20edges%20of%20the%20lips.
৯.http://www.ultimateungulate.com/Artiodactyla/Boselaphus_tragocamelus.html
১০.https://www.encyclopedia.com/environment/applied-and-social-sciences-magazines/deer-swamp
১১.https://worlddeer.org/barasingha-deer/
১২.https://www.kaziranganationalpark.com/barasingha.htm
১৩.http://www.ultimateungulate.com/artiodactyla/antilope_cervicapra.html
১৪.https://animals.fandom.com/wiki/Blackbuck
১৫.https://www.researchgate.net/publication/301746989_Bubalus_arnee_The_IUCN_Red_List_of_Threatened_Species_2008
১৬.https://animaldiversity.org/accounts/Boselaphus_tragocamelus/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top