বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দশটি নদীর তালিকা।।

বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ।আমাদের দেশের চারপাশে জালের মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নদ-নদী।জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের তথ্যমতে,বর্তমানে দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ১০০৮ টি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নদী “পদ্মা”,যা ১২ টি জেলার মধ্য দিয়ে ৩৪১ কি.মি পথ অতিক্রম করেছে।আর সবচেয়ে ছোট নদী ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট দিয়ে প্রবাহিত “গাঙ্গিনা” যার দৈর্ঘ্য মাত্র ০.০৩২ কি.মি।

সবচেয়ে বেশী জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে পদ্মা ও মেঘনা নদী (১২ টি),বেশী উপজেলা অতিক্রম করেছে মেঘনা নদী (৩৬ টি)।ঢাকা বিভাগ দিয়ে সর্বোচ্চ ২২২ টি নদী বয়ে গেছে।আর একক জেলা হিসেবে সুনামগঞ্জ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ৯৭ টি নদী।
চলুন আজ জেনে নেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নদী গুলোর মধ্যে দীর্ঘতম দশটি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য।

১.পদ্মাঃ (৩৪১ কি.মি)

বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদী পদ্মা হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপত্তি লাভ করে নেপাল,ভারতের বিহার,ঝাড়খন্ড,উত্তর প্রদেশ,উত্তরাখণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ অতিক্রম করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মনাকশার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।ভারতে এটি গঙ্গা নামে পরিচিত।

পদ্মা বাংলাদেশের রাজশাহী,চাঁপাইনবাবগঞ্জ,কুষ্টিয়া,পাবনা,নাটোর,রাজবাড়ি,ঢাকা,মানিকগঞ্জ,মাদারিপুর,শরীয়তপুর,ফরিদপুর,মুন্সিগঞ্জ,চাঁদপুর এই ১২ টি জেলাকে অতিক্রম করেছে।

বাংলাদেশ অংশে এর দৈর্ঘ্য ৩৪১ কি.মি।গড় প্রস্থ ৩ কি.মি।সর্বাধিক প্রস্থ মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে ৫.৭ কি.মি।তবে তীব্র ভাঙনপ্রবণ হওয়ায় নদীটির প্রকৃত প্রশস্ততা নির্ধারণ করা মুশকিল।

পানিপ্রবাহের দিক দিয়ে বিশ্বে পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার অবস্থান দ্বিতীয়।আমাজন নদীর পর প্রতি সেকেন্ডে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (প্রায় ৪৪ হাজার কিউসেক) পানি প্রবাহিত করে এই অববাহিকা।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব-দ্বীপটিও (বঙ্গেয় ব-দ্বীপ) গড়ে উঠেছে এই অববাহিকাতে।

পদ্মা রাজবাড়ির গোয়ালন্দের নিকট যমুনা নদীর সাথে মিলিত হয়ে পূর্ব দিকে আবারও পদ্মা নামে প্রবাহিত হয়েছে।

আর চাঁদপুরের নিকট মেঘনার সাথে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।

পদ্মার প্রধান উপনদী মহানন্দা ও পুনর্ভবা।
গড়াই,কুমার,মাথাভাঙ্গা,কপোতাক্ষ,আড়িয়াল খাঁ এর শাখানদী।পশুর,মধুমতি,ভৈরব পদ্মার উপশাখা নদী।

২.ইছামতিঃ (৩৩৪ কি.মি)

জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের তথ্যমতে দেশ ইছামতি নামে নদীর অস্তিত্ব রয়েছে মোট ১১ টি।
এর মধ্যে যশোর,ঝিনাইদহ,চুয়াডাঙ্গা ও সাতক্ষীরা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ইছামতি দেশের ২য় দীর্ঘতম নদী,যার দৈর্ঘ্য ৩৩৪ মি।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার মাঝদিয়ার কাছে মাথাভাঙ্গা নদী দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে একটি শাখা চুর্ণী নামে ভারতের দিকে এবং অপর শাখাটি ইছামতি নামে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার মদনা ইউনিয়ন দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

এরপর এটি পুণরায় ঝিনাইদহের মহেশপুরের কাজিরবেড় দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে।

ভারতে কিছু দূরত্ব অতিক্রম করার পর এটি যশোরের শার্শার পুটখালী সীমান্ত দিয়ে আবারও বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

এরপর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বরাবর প্রবাহিত হয়ে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের রায়মঙ্গল নদীতে পতিত হয়েছে।

মাথাভাঙ্গা,আমড়াখালী,হাঁকর,কাঁকশিয়ালী ইছামতির প্রধান উপনদী।শাখানদীর মধ্যে চিত্রা,ভৈরব,মারিচ্চাপ উল্লেখযোগ্য।

একসময় জাহাজ চলাচল করলেও বর্তমানে নাব্যতা সংকটে রয়েছে নদীটি।নদীতে পলিমাটি জমা হওয়ায় বর্ষায় দুতীরে বন্যার সৃষ্টি হয়।

ইছামতি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি পবিত্র নদী হিসেবে পরিচিত।

৩.সাঙ্গুঃ (২৯৪ কি.মি)

বাংলাদেশের পূর্বের পাহাড়ি অঞ্চলের নদী সাঙ্গুর দৈর্ঘ্য ২৯৪ কি.মি।এর গড় প্রস্থ ১১৯ মিটার।

সাঙ্গু বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী আরাকান পার্বত্য এলাকার অন্তর্গত বান্দরবানের থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নের মোদক অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকা থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে।

সর্পিলাকার নদীটি বান্দরবান ও চট্টগ্রাম জেলা অতিক্রম করে বাঁশখালির কাছ দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।

মার্মা শব্দ শঙ্খ থেকে “সাঙ্গু” নামটির উৎপত্তি।সাঙ্গু-তীরবর্তী প্রায় ৯০% লোকই মার্মা সম্প্রদায়ের।

বাংলাদেশের প্রায় সব নদীই দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হলেও সাঙ্গুর ক্ষেত্রে এটা কিছুটা ব্যতিক্রম।নদীটি প্রথমে দক্ষিণ থেকে উত্তরে,পরে উত্তর থেকে পূর্বে,সর্বশেষ পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।

সাঙ্গুর দু-তীরের পাহাড়,ঘন বন ও ঝর্ণার সৌন্দর্য যেকোনো পর্যটককেই বিমোহিত করতে বাধ্য।

বছরের বেশিরভাগ সময় নদীতে নাব্য সংকট দেখা দিলেও বর্ষাকালে নদীটি হয়ে ওঠে খরস্রোতা।

বান্দরবানের দুর্গম রুমা ও থানচিতে কৃষি ও অন্যান্য পণ্য পরিবহনে সাঙ্গুর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে।

চাঁদখালী,ডলু,কুমিরাখালী সাঙ্গুর প্রধান উপনদী।শাখানদীর মধ্যে জলকাদার,মুরালি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

৪.কুশিয়ারাঃ (২৮৮ কি.মি)

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদী কুশিয়ারা সিলেটের জকিগঞ্জের অমলসিদ নামক স্থানে বরাক নদী থেকে উৎপত্তি হয়েছে।

বরাক নদী ভারতের মনিপুরের আঙ্গামীনাগা পাহাড় থেকে উৎপত্তি লাভ করে আসামের কাছাড় জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে জকিগঞ্জের ঠাকুরিয়া ইউনিয়ন দিয়ে সিলেটে প্রবেশ করেছে।
এরপর অমলসিদ নামক স্থানে বরাক দ্বিখন্ডিত হয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে প্রবাহিত হয়েছে।

কুশিয়ারা সিলেট,হবিগঞ্জ,সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার অতিক্রম করে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের কালমা ইউনিয়নের কাছে পতিত হয়ে বাটিতে মেঘনা নদীর সৃষ্টি করেছে।

সর্পিলাকার নদীটির দৈর্ঘ্য ২৮৮ কি.মি।গড় প্রস্থ ২৬৮ মিটার।

সিলেট অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নদীটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।সিলেটের বিখ্যাত পাথর ও বালুর বেশীরভাগ এই নদী দিয়েই সারাদেশে পরিবহন করা হয়।

নদীটির ভাটি অঞ্চলে জোয়ার-ভাটার প্রভাব বিদ্যমান।
জুরী,কালনী,মনু,দেওরবাগা,বাঁশিয়া,ইসদার বারভাঙ্গা এর প্রধান উপনদী।শাখানদীর মধ্যে সোনাই-বরদাল উল্লেখযোগ্য।

৫.সুরমাঃ (২৪৯ কি.মি)

কুশিয়ারার মতো সুরমাও সিলেটের জকিগঞ্জের অমলসিদ নামক স্থানে বরাক নদী থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে।
বরাক নদী ভারতের মনিপুরের আঙ্গামীনাগা পাহাড় থেকে উৎপত্তি হয়ে আসামের কাছাড় জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে জকিগঞ্জের ঠাকুরিয়া ইউনিয়ন দিয়ে সিলেটে প্রবেশ করেছে।

এরপর অমলসিদ নামক স্থানে বরাক দুভাগে বিভক্ত হয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে প্রবাহিত হয়েছে।

সুরমা সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা অতিক্রম করে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার গজারিয়া বাজারের নিকট বাউলাই নদীতে পতিত হয়েছে।

নদীটির দৈর্ঘ্য ২৪৯ কি.মি।গড় প্রস্থ ১১১ মিটার।

জনশ্রুতি অনুযায়ী,রাজা ক্ষেত্রলালের কন্যা সুরম্যার নামানুসারে এই নদীর নামকরন করা হয়।

পূর্বে এটি বরবক্র নামে পরিচিত ছিলো।প্রাচীন পুরাণে উল্লেখিত শরাবতী নদীকে অনেক গবেষকই সিলেটের সুরমা হিসেবে ধারণা করেন।

বরাক নদীর পানিপ্রবাহের প্রায় ৪০% সুরমা ও বাকি অংশ কুশিয়ারা দিয়ে প্রবাহিত হলেও সুরমাকেই নদী গবেষকেরা বরাকের মূল প্রবাহ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

সুরমার বাকি ৬০% পানিপ্রবাহ আসে ভারতের খাসিয়া-জয়ন্তিয়া পাহাড়ের লোভাছড়া ও বিভিন্ন উপনদী-শাখানদী থেকে।

আসাউরা,ছিলাই,ধালাই,যাদুকাটা,খাসিমারা,লুভা,কুশিয়া,পিনাইন এর প্রধান উপনদী।শাখানদীগুলোর মধ্যে বাহিয়া গাঙ,বটরখাল,বকি,দোলতা,ইসদার খাল,মরা সুরমা,বাউলাই,খাজাংচি ইত্যাদি এর উল্লেখযোগ্য শাখানদী।

আরও পড়ুনঃ পৃথিবীর দীর্ঘতম দশটি নদীর তালিকা।

৬.ভৈরবঃ (২৪২ কি.মি)

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত ভৈরব নদীর দৈর্ঘ্য ২৪২ কি.মি।এর গড় প্রস্থ ৬০ মিটার।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নদী গুলোর তালিকাতে এর অবস্থান ৬ষ্ঠ।

সরু ও সর্পিলাকার এই নদীটি চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার সুবলপুরে মাথাভাঙ্গা নদী থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে।

এরপর এটি চুয়াডাঙ্গা,ঝিনাইদহ,যশোর,নড়াইল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে খুলনা শহরের কাছে রূপসা নদীতে পতিত হয়েছে।

মাথাভাঙ্গা,দৈতরা খাল,আফ্রা,আতাই ভৈরবের প্রধান উপনদী।শাখানদীর মধ্যে রূপসা,কপোতাক্ষ উল্লেখযোগ্য।

একসময় গঙ্গা-পদ্মার মূলপ্রবাহের সাথে সংযুক্ত থাকায় নদীটি ছিলো গভীর ও খরস্রোতা।নদীটি দিয়ে তখন চলাচল করতো বড় বড় পালতোলা নৌকা।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রসিদ্ধ শহরগুলোও এই নদীর তীরে গড়ে উঠেছিলো।এরমধ্যে যশোর,খুলনা,বারোবাজার,কোর্টচাঁদপুর উল্লেখযোগ্য।

বর্তমানে পলিমাটি জমায় নদীটি নাব্য সংকটে রয়েছে।কোথাও পরিণত হয়েছে মৃতপ্রায় খালে,আবার কোথাও স্রোতহীন বদ্ধ জলাশয়ে।

সরকারী উদ্যোগে যশোরে ভৈরবের ৯২ কি.মি পুণরায় খনন করা হলেও এই প্রকল্পে তেমন সুফল মেলেনি।নদীটির অস্তিত্ব বাঁচাতে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।

৭.বংশাইঃ (২৩৯ কি.মি)

বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের দিয়ে প্রবাহিত বংশাই যা স্থানীয়ভাবে বংশী নদী হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত।

সর্পিলাকার এই নদীটি জামালপুরের শরীফপুর ইউনিয়নের বানার (আপার) নদী থেকে উৎপত্তি লাভ করে ঢাকার ধামরাই উপজেলাতে ধলেশ্বরী নদীতে পতিত হয়েছে।

চলার পথে এটি জামালপুর,টাঙ্গাইল,গাজীপুর ও ঢাকা জেলার ১০ টি উপজেলাকে অতিক্রম করেছে।

নদীর দৈর্ঘ্য ২৩৯ কি.মি।এর গড় প্রস্থ ৪৯ মিটার।

বংশাইয়ের উপনদীগুলোর মধ্যে ঝিনাই,টাংকী খাল,লৌহজং নদী,এলেনজানী,গুজা, মরগানী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।তুরাগ,বালু এর প্রধান শাখানদী।

একসময় বংশাই তার অববাহিকা এলাকাগুলোর পণ্য পরিবহনের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে নদীটি মৃতপ্রায়।

ঢাকা অংশে কিছুটা নাব্য থাকলেও গাজীপুর,জামালপুর ও টাঙ্গাইলে নদীটি মরা খালে পরিণত হয়েছে।

গাজীপুরে বংশাই দখল করে বাঁধ দিয়ে রাস্তা নির্মাণ

কলকারখানার বর্জ্য,পলিমাটি জমা হওয়া,দখল আর দুষণের কারণে এর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।

বিশেষ করে টাঙ্গাইলের ৭৬ কিমি নদী এলাকা সবচেয়ে বেশী দখলের শিকার।

একসময় দেশী মাছের অভয়ারণ্য ছিলো বংশাই নদী।তবে বর্তমানে ধামরাই,সাভার ও গাজীপুরের শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য পড়ায় এর নদীর পানি রং কালচে হয়ে গেছে।ফলে এ এলাকাগুলোতে জলজ প্রাণী প্রায় বিলুপ্তির পথে।

৮.পুরাতন ব্রহ্মপুত্রঃ (২৩০ কি.মি)

পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার হরিচন্ডীবাজার এর কাছে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে।পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ তৈরির ইতিহাস অনেকটা নাটকীয়।

ব্রহ্মপুত্র নদ চীনের তিব্বতের কৈলাস শৃঙ্গের মানস সরোবর থেকে উৎপত্তি হয়ে ভারতের আসাম পর্বতমালার লোহিত্য সরোবরের স্রোতের ধারার সাথে মিলিত হয়ে কুড়িগ্রামেরর উলিপুর উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

১৭৮২ সালে বৃহত্তম ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রায় ৮.৮ মাত্রার ভুমিকম্পের কারণে গাইবান্ধার ফুলছড়ির হরিচন্ডীবাজারের কাছে ব্রহ্মপুত্রের তলদেশ উত্থিত হয়ে একটি শাখা সৃষ্টি হয় যা জোনাইখাল দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে,আর বাকি স্রোত পুরোনো গতিপথ দিয়েই প্রবাহিত হয়।

এরপর ১৭৮৭ সালে বড় ধরনের বন্যা এবং তিস্তা,ব্রহ্মপুত্র ও জোনাইখালের সম্মিলিত প্রবাহধারা মিলে যমুনা নদীর সৃষ্টি হয়।

আর ব্রহ্মপুত্রের পুরোনো স্রোতধারাটি পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নামে গাইবান্ধা,শেরপুর,জামালপুর,ময়মনসিংহ,নরসিংদী,গাজীপুর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কিশোরগঞ্জের ভৈরববাজারের নিকটে মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে।

পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর দৈর্ঘ্য ২৩০ কি.মি।এর গড় প্রস্থ ২০০ মিটার।

নদীটি প্রায় সারাবছরই নাব্য থাকে তবে এটি বন্যা ও ভাঙনপ্রবণ।

ব্রহ্মপুত্র,জিঞ্জিরাম,মিরগী ও মরা জিঞ্জিরাম এর প্রধান উপনদী।শাখানদীর মধ্যে আড়িয়াল খাঁ,বানার আপার,বানার লোয়ার,ঝিনাই,নরসুন্দা,শীতলক্ষ্যা,সুতিয়া,ধলেশ্বরী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

৯.পুনর্ভবাঃ (২২৩ কি.মি)

পুনর্ভবা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম একটি নদী।বাংলাদেশ থেকে উৎপত্তি হয়ে যে তিনটি নদী ভারতে প্রবেশ করেছে তার মধ্যে এটি অন্যতম।

পুনর্ভবা দিনাজপুরের বীরগঞ্জের শিবরামপুর ইউনিয়নের বিলাঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়েছে।

এরপর দিনাজপুরে কিছুদূর প্রবাহিত হয়ে সদর উপজেলার আস্করপুর ইউনিয়নের সুন্দরা সীমান্ত দিয়ে ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় প্রবেশ করেছে।

এরপর পুণরায় নওগাঁর সাপাহার উপজেলার পাতাড়ি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে কখনও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আবার কখনও পশ্চিমবঙ্গের মালদহ সীমান্ত ঘেঁষে প্রবাহিত হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের জলাভূমি অতিক্রম করে রোহনপুর ইউনিয়নের মকরমপুরে মহানন্দা নদীতে পতিত হয়েছে।

দিনাজপুর,নওগাঁ,চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মধ্যে ৭ টি উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত সর্পিলাকার এই নদীটির দৈর্ঘ্য ২২৩ কি.মি,গড় প্রস্থ ১০২ মিটার।

নদীটি জোয়ার-ভাটা দ্বারা প্রভাবিত নয়।

টাঙ্গন,কুলিখ,নাগর,নর্ত,ঢেপা,নোনা পুনর্ভবার প্রধান উপনদী।

নওগাঁর সাপাহারে পুনর্ভবা নদীগর্ভে খেলছে বাচ্চারা

শুষ্ক মৌসুমে নদীটির দিনাজপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অংশে কিছুটা পানি থাকলেও নওগাঁ অংশের বেশীভাগ শুকিয়ে বালুচরে পরিণত হয়।তাই একসময়কার উত্তাল পুনর্ভবাকে বাঁচাতে নদীটি খনন করা এখন অত্যন্ত জরুরী।

আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশের দীর্ঘতম দশটি সেতুর তালিকা।

১০.মেঘনাঃ (২২১ কি.মি)

দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত মেঘনা নদীর দৈর্ঘ্য ২২১ কি.মি।এর গড় প্রস্থ ৩.৪ কিমি।নদীটির সর্বাধিক প্রস্থ ভোলার মোহনার কাছে ১৩ কি.মি।গড় গভীরতা ৩০৮ মিটার।

চিরযৌবনা এই নদীটি বাংলাদেশের প্রশস্ততম ও গভীরতম নদী।পানিপ্রবাহের দিক দিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নদী ও বিশ্বের ২য় বৃহত্তম নদী।

আমাজনের পরেই পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকা দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে বিশ্বের সবচেয়ে বেশী পানি প্রবাহিত হয়।

সুরমা ও কুশিয়ারার মিলিত স্রোত কালনী নামে প্রবাহিত হয়ে কিশোরগঞ্জের ভৈরব বাজারের কাছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলিত হয়ে মেঘনা নদীর সৃষ্টি করেছে।

এরপর এটি দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে চাঁদপুরের কাছে পদ্মার সাথে মিলিত হয়ে মেঘনা নামেই ভোলার মনপুরা ইউনিয়ন হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।

চলার পথে নদীটি কিশোরগঞ্জ,নরসিংদী,নারায়নগঞ্জ,মুন্সিগঞ্জ,শরীয়তপুর,নোয়াখালী,কুমিল্লা,ব্রাহ্মণবাড়িয়া,চাঁদপুর,লক্ষীপুর,বরিশাল,ভোলা জেলার ২৬ টি উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

মেঘনার প্রধান উপনদীগুলোর মধ্যে আড়িয়াল খাঁ,বেলনা,ব্রহ্মপুত্র,পুরাতন ব্রহ্মপুত্র,কালনী,ধলেশ্বরী,গোমতী,হাড়িদোয়া,পদ্মা,বলভদ্রা,সুতং উল্লেখযোগ্য।বিশনন্দী,ডাসাডিয়া,কাটাখালী,মিনিখালী,পাগলা ইত্যাদি এর প্রধান শাখানদী।

মেঘনা নদীর অববাহিকা দিয়ে ভারতের মেঘলয়ের খাসিয়া-জয়ন্তিয়া পাহাড় ও চেরাপুঞ্জি থেকে প্রবাহিত জলস্রোত,পদ্মা,সুরমা,কুশিয়ারা,ব্রহ্মপুত্রসহ দেশের প্রায় ৯০% নদীর পানি বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হয়।

এজন্য নদীটি অত্যন্ত গভীর ও সারাবছরই নাব্য থাকে।
চাঁদপুরে পদ্মা-মেঘনার মিলনস্থলে প্রচুর ইলিশ মাছ পাওয়া যায়।

তথ্যসূত্র:
১.https://nrcc.gov.bd/
২.https://bwdb.portal.gov.bd/
৩.https://en.prothomalo.com
৪.মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক,বাংলাদেশের নদনদী:বর্তমান গতিপ্রকৃতি,কথাপ্রকাশ
৫.https://dialogue.earth/en/water/sohara-mehroze-shachi/
৬.https://sylhetpedia.com/49/%e0%a6%b8%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a6%ae%e0%a6%be-%e0%a6%a8%e0%a6%a6%e0%a7%80/
৭.https://bn.m.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AD%E0%A7%88%E0%A6%B0%E0%A6%AC_%E0%A6%A8%E0%A6%A6
৮.https://bn.banglapedia.org/index.php?title=%E0%A6%AA%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%A8_%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B9%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%AA%E0%A7%81%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0_%E0%A6%A8%E0%A6%A6
৯.https://bn.m.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A6%98%E0%A6%A8%E0%A6%BE_%E0%A6%A8%E0%A6%A6%E0%A7%80
১০.https://bn.m.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%87%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%A4%E0%A6%BF_%E0%A6%A8%E0%A6%A6%E0%A7%80
১১.https://www.kalerkantho.com/print-edition/news/2023/12/21/1347795
১২.https://g.co/kgs/8T53Kto

Back To Top