ঢাকার বিভিন্ন এলাকার নামকরণের ইতিহাস!!

ঢাকার বিভিন্ন এলাকার নামকরণ

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা।১৬১০ সালে সুবা বাংলার রাজধানী হওয়ার পর থেকেই শহরটির রয়েছে ৪১২ বছরের সম্বৃদ্ধ ইতিহাস।গড়ে উঠছে অসংখ্য আবাসিক এলাকা,অফিস-আদালত,কলকারখানাসহ অসংখ্য স্থাপনা।

কত বাহারি নামই না রয়েছে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার।কখনও কি জানতে ইচ্ছা করেছে এসব এলাকার নামকরণের ইতিহাস?

জানার আগ্রহ থাকলে চলুন আজ জেনে নেই ঢাকা শহরের এমন উল্লেখযোগ্য কিছু এলাকার নামকরণের ইতিহাস।

ধানমন্ডিঃ

ধান কি জিনিস তা আমরা সবাই জানি,আর ‘ফারসি’ শব্দ ‘মন্ডি’ মানে বাজার।ব্রিটিশ শাসনামলে ঢাকার সবচেয়ে বড় ধানের বাজারটি যে এলাকাটিতে বসতো সেটিই আজ ধানমন্ডি নামে পরিচিত।

পিলখানাঃ

পিলখানা শব্দটিও ফারসি ভাষা থেকে আগত।ফারসি ভাষায় পিল শব্দের অর্থ হাতি আর খানা শব্দের অর্থ জায়গা।পিলখানা শব্দের অর্থ হাতি রাখার জায়গা।

মুঘল শাসকদের খুব পছন্দের একটি খেলা ছিলো হাতির লড়াই।তাই সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে হাতি এনে রাখা হতো ধানমন্ডির একটি জায়গায়,যেটি লোকমুখে পরিচিতি পেয়ে যায় পিলখানা নামে।

মাহুতটুলিঃ

মাহুত শব্দের অর্থ হস্তিচালক।সাধারণত যারা হাতি পোষ মানাতো ও দেখাশোনা করতো তাদেরকে মাহুত বলা হতো।মোঘল শাসনামলে হাতির সাথে ঢাকায় এসেছিলো বিপুল সংখ্যক মাহুতও।তারা নিজেদের বসবাসের জন্য যে এলাকাটি গড়ে তুলেছিলো সেটিই আজ মাহুতটুলি নামে পরিচিত।

হাতিরঝিলঃ

হাতি আনাও হলো,রাখাও হলো,পোষ মানানোও হলো।কিন্তু হাতি পালার হাজারটা ঝামেলা আছে।সেসবের মধ্যে একটি হলো হাতির গোসল করানো ও রোদ পেহাবার ব্যবস্থা করা।গোছল করানোর জন্য হাতিকে নিয়ে যাওয়া হতো নিকটস্থ একটি বড় ঝিলে,যেটি আজ হাতিরঝিল নামে সর্বাধিক পরিচিত।

এলিফ্যান্ট রোডঃ

পিলখানা থেকে হাতিগুলোকে হাতিরঝিল এনে গোসল করিয়ে এদেরকে নিয়ে যাওয়া হতো রমনা পার্কে রোদ পোহানোর জন্য।তারপর আবার নিয়ে যাওয়া হতো এদের ডেরা পিলখানাতে।
হাতিদের রমনা থেকে পিলখানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যে রাস্তাটি ব্যবহার করা হতো সেটিই আজ এলিফ্যান্ট রোড নামে পরিচিত।

হাতিরপুলঃ

এলিফ্যান্ট রোডের মাঝে প্রাচীনকালে একটি খাল ছিলো,যার উপরে একটি কাঠের পুল তৈরি করা হয়েছিলো যাতে হাতিরা নির্বিঘ্নে খালটি পার হতে পারে।বর্তমানে কাঠের পুলের আশেপাশের এই এলাকাটিই আজ হাতিরপুল নামে পরিচিত।

ভুতের গলিঃ

এলিফ্যান্ট রোড ধরে হাতিরপুল আসার পথে একটু বামেই গড়িটি অবস্থিত।এটি বিখ্যাত তার এই নামের কারণে।তবে ভয়ের কিছু নেই।গলিটিতে কোনো ভুত বা ভুতের বাড়ি নেই।

ইংরেজ আমলে গলিটিতে বাস করতেন একজন ইংরেজ সাহেব।নাম মিস্টার বুথ।ওই এলাকাটিতে তিনিই ছিলেন কোনো প্রথম ইংরেজ।তার নামানুসারেই গলিটির নামকরণ করা হয় ‘বুথের গলি’।কালক্রমে সেটিই বাঙালিদের কাছে ভুতের গলি নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

গেন্ডারিয়াঃ

তৎকালীন সময়ে বাংলার বিখ্যাত জমিদার ও প্রভাবশালীদের বাস ছিলো এলাকাটিতে।এজন্য ব্রিটিশরা এলাকাটিকে “গ্র্যান্ড এরিয়া” নামকরণ করেন।কিন্তু বাঙালির মুখে তো এমন কঠিন দূর্বোধ্য শব্দ শোভা পায়না।তার নিজেদের উচ্চারণের সুবিধার্থে ধীরে ধীরে এলাকাটির নাম হয়ে যায় গেন্ডারিয়া।

আরও পড়ুনঃ ৪৭ এর দেশভাগঃ বাংলাভাগ হলো যেভাবে!!

রমনাঃ

পূর্বেই বলেছিলাম মোঘল আমলে হাতিদের হাতিরঝিলে গোসল করিয়ে রোদ পোহানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হতো রমনা পার্কে।পার্কটির নিজস্ব নামকরণের ইতিহাস রয়েছে।

এলাকাটিতে বাস করতেন ধর্ণাঢ্য ব্যবসায়ী রম নাথ বাবু।তিনি নিজের নামে এলাকাটিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন “রমনা কালী মন্দির”। আর সেই মন্দিরের পাশে বানিয়েছিলেন ফুলের বাগান ও খেলার মাঠ।
সেই রমনা কালী মন্দির থেকেই এলাকাটি রমনা নামে পরিচিতি লাভ করে।

কাকরাইলঃ

আমাদের দেশে সম্মানিত ব্যক্তির নামে সড়কের নামকরণের চর্চাটি ব্রিটিশ আমল থেকেই হয়ে আসছে।১৯ শতকের শেষের দিকে ঢাকার কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান মি. ককরেল।তাকে সম্মান জানিয়ে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয় ককরেল রোড।রোডটি যে এলাকার মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল সেটিই কালক্রমে বিকৃত হয়ে কাকরাইল নামে পরিচিতি লাভ করে।

আজিমপুরঃ

আজিমপুর নামকরণ নিয়ে কিছুটা বিতর্ক রয়েছে।ইতিহাসবিদদের একপক্ষ মনে করেন এলাকাটি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলো সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র সুবাদার শাহজাদা আজমের শাসনামলে।সেখান থেকেই আজিমপুর শব্দটি এসেছে।

অন্য আরেক পক্ষের অভিমত,আওরঙ্গজেবের পুত্র নন,এলাকাটির প্রতিষ্ঠা করেন তার নাতি সুবাদার আজিমুশ্বান।তার নামানুসারেই এলাকাটি আজিমপুর নামে পরিচিতি লাভ করে।

তবে এলাটি যেই প্রতিষ্ঠা করুক না কেন,প্রাচীনকাল থেকে এটি সরকারি কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা ছিলো।বর্তমানেও এখানে সরকারি কোয়ার্টার রয়েছে।

কারওয়ান বাজারঃ

কারওয়ান বাজারের উৎপত্তি ” কারাবান” শব্দ হতে যার অর্থ “সরাইখানা”।

দিল্লীর সুলতান শেরশাহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড বা সড়ক-ই-আজম।পরবর্তীতে সুবাদার শায়েস্তা খানের আমলে সড়কটি ঢাকা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।

তখন এই সড়কের কিছুদূর পরপর নির্মাণ করা হয় সরাইখানা বা ” কারাবান”।তেমনই একটি বিখ্যাত কারবান ছিলো বর্তমানে কারওয়ান বাজারে।পরবর্তীতে এখানে একটি বাজার প্রতিষ্ঠিত করা হয়।বর্তমানে পুরো এলাকাটিই কারওয়ান বাজার নামে পরিচিত।

শাহবাগঃ

শাহবাগ শব্দের আভিধানিক অর্থ রাজকীয় বাগান।মুঘল সম্রাটরা যখন ঢাকাকে প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দেন তারপর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে দৃষ্টিনন্দন বাগান গড়ে তোলেন।তেমন একটি বিরাট ও দৃষ্টিনন্দন বাগান গড়ে তোলা হয় শাহবাগে।

অবশ্য বর্তমানে বাগানটির সামান্য স্মৃতিচিহ্নও চোখে পড়েনা।তবে এখনও রয়ে গেলে সাধারণ মানুষের স্মৃতিতে,যার কারণে এখনও এলাকাটি শাহবাগ নামে পরিচিত।

পরীবাগঃ

শাহবাগের অদূরেই পরীবাগ অবস্থিত।পরীবানু ছিলেন নবাব সলিমুল্লাহর সৎবোন।নবাব সলিমুল্লাহ এই এলাকাটিতে তার সৎবোনের জন্য একটি বাগানবাড়ি তৈরি করে দেন।সেখানেই পরীবানু বাস করতেন।তার নামানুসারেই এলাকাটি পরিচিতি লাভ করে পরীবাগ হিসেবে।

শ্যামলীঃ

শ্যামলীর নামকরণের ইতিহাস খুব একটা প্রাচীন নয়।একটা সময় শ্যামলী এলাকাটি ছিলো ঘন জঙ্গল ও গাছপালায় ঘেরা।সবুজ-শ্যামলিমায় ঘেরা এলাকাটিকে ১৯৫৭ সেখানকার অধিবাসী সমাজকর্মী আব্দুল গণিসহ আরও কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি মিলে নাম দেন শ্যামলী।

মগবাজারঃ

মগবাজার নামটি এসেছে “মগ” অধিবাসীদের থেকে।এদের আদিনিবাস চট্টগ্রাম হলেও এরা ঢাকায় এলো কিভাবে তা জানতে ফিরে যেতে হবে ১৬২০ সালে,যখন মগ রাজা তৎকালীন মুঘল সুবা বাংলায় আক্রমণ চালায়।

এরপর মুঘল সুবাদার ইসলাম খান মগদের তৎকালীন ঘাটি চট্টগ্রামে আক্রমণ করে।পরবর্তীতে মগ রাজা মুকুট রায় ও তার অনুসারীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে ইসলাম খান তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং ঢাকার একটি বিশেষ এলাকায় থাকার অনুমতি প্রদান করেন।সেটিই আজ মগবাজার নামে পরিচিত।

ইতিহাসবিদদের মতে এলাকাটিতে একসময় ঘন জঙ্গল ছিলো।সেখানে অনেক হিংস্র জন্তুও বাস করতো।

ইস্কাটনঃ

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে বানিজ্যকেন্দ্র হিসেবে ঢাকার সুখ্যাতি ছিলো পুরো ইউরোপজুড়ে।ইউরোপরে নানা দেশের বণিকেরা ভীড় জমাতো ঢাকাতে।গড়ে তুলতো নিজেদের আস্তানা।

এক্ষেত্রে বাদ যায়নি স্কটল্যান্ডের বণিকেরাও।একসময় ঢাকার বিখ্যাত “সোনালী আঁশ” পাটের একচেটিয়া ব্যবসা ছিলো স্কটিশদের হাতেই।তারা নিজেদের বসবাসের জন্য একটি বসতিও গড়ে তুলেছিল ঢাকাতে।সেখানে ছিলো চার্চসহ বিভিন্ন স্থাপনা।সেই বসতি এলাকাটিই বর্তমানে ইস্কাটন নামে পরিচিত।

চকবাজারঃ

ঢাকার একটি বিখ্যাত এলাকা চকবাজার।ব্যবসা-বানিজ্য ও বিশাল ইফতার বাজার বসার জন্য এলাকাটি রাজধানীর প্রায় সবার কাছেই পরিচিত।মজার বিষয় হলো এর পূর্বনাম ছিলো চৌকবন্দর।

তখনকার সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান বানিজ্যকেন্দ্র ছিলো এটি।চৌকবন্দর থেকেই বর্তমান চকবাজার নামের উৎপত্তি হয়েছে।

১৭০২ সালে নবাব মুর্শিদকুলি খানের হাত ধরেই এটি আধুনিক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ বাজারে রুপান্তরিত হয়।পরবর্তীতে ওয়াল্টার সাহেব এটির সংস্কার ও পুণঃনির্মাণ করেন।

আরও পড়ুনঃ একুশ শতকে স্বাধীন হয়েছে যে দেশগুলো।

মালিবাগঃ

পূর্বেই বলেছি একটা সময় ঢাকায় বাগানের অভাব ছিলোনা।ঢাকা সুবা বাংলার রাজধানী হবার পর থেকেই অসংখ্য বাগান গড়ে ওঠে শহরটিতে।সেসব বাগানের দেখভাল করার জন্য ছিলো অসংখ্য মালি।সেসব মালিরা নিজেদের বসবাসের জন্য একটি এলাকা গড়ে তোলে।সাথে এলাকাটিতে অসংখ্য বাগানও গড়ে তোলোন।সেই এলাকাটিই আজ মালিবাগ নামে পরিচিত।

ইংলিশ রোড ও ফ্রেন্স রোডঃ

নাম শুনল আন্দাজ করা যায় যে,এই দুইটি সড়কের আশেপাশে হয়তো ইংরোজ ও ফ্রেন্স বসতি গড়ে উঠেছিল।কিন্তু মজার বিষয় হলো রোডটির নামে কোনো জাতিবিশেষের বসতির কারণে দেওয়া হয়নি।দেওয়া হয়েছে দুইজন ব্যক্তির নামে।

একসময় ঢাকার কমিশনার ছিলেন মিস্টার ইংলিশ।তার সম্মানার্থে ধোলাইপাড়ের একটি রাস্তার নামকরণ করা হয় “ইংলিশ রোড”।

একইভাবে ঢাকার অপর এক কমিশনারের নাম ছিলো মিস্টার এফসি ফ্রেন্স।তার সম্মানার্থে ১৯১৮ সালে পুরান ঢাকার একটি রোডের নামকরণ করা হয় ফ্রেন্স রোড।

ফরাশগঞ্জঃ

বুড়িগঙ্গার তীরে ফারসি বণিকের স্মৃতিবিজড়িত একটি এলাকার নাম ফরাশগঞ্জ।১৭৮০ সালে ঢাকার তৎকালীন নিমতলী কুঠিরের নায়েব নাজিম নওয়াজেশ মোহাম্মদ খানের অনুমতি নিয়ে ফরাসি বণিকেরা সেখানে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন।বাজারটিতে কাঁচা হলুদ,আদা,রসুন,মরিচের পাইকারি আড়ৎ ছিলো।

শুরুতে বাজারটির নাম দেওয়া হয়েছিলো ফ্রেন্সগঞ্জ।কিন্তু লোকমুখে বিকৃত হতে হতে বর্তমানে৷ তা ফরাশগঞ্জ নামে পরিচিত।

ওয়ারীঃ

বর্তমানে ঢাকা শহরে গুলশান,বনানী,বারিধারার মতো অসংখ্য অভিজাত এলাকা রয়েছে।অথচ উনিশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত ঢাকা শহরে তেমন কোনো অভিজাত এলাকাই ছিলোনা।তাই ১৮৮৪ সালে ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকায় একটি অভিজাত এলাকা গড়ে তুলবেন।

যখন এই এলাকা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল,সেসময়ে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্বপালন করছিলেন মিস্টার অয়্যার।পৌরসভা তার সম্মানে এলাকাটির একটি রাস্তার নামকরণ করেন ওয়্যার স্ট্রিট।কিন্তু স্থানীয়দের মুখে বিকৃত হতে হতে পুরো এলাকাটি এখন “ওয়ারী” নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

বংশালঃ

ইংরেজি নামকে বাঙালীরা যে কতটা বিকৃতিসাধন করেছে তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ বংশাল।
মেরামতের জন্য বিভিন্ন নৌযানকে নৌবন্দরের যে বিশেষ তীরে নোঙ্গর করা হতো তাকে ব্যাঙ্কশাল বলা হতো।সেই ব্যাঙ্কশাল এলাকায় নাম বিকৃত হয়ে বর্তমানে বংশাল নামে পরিচিত।

একটা সময় ঢাকার ধোলাইখাল বুড়িগঙ্গা নদীর সাথে সংযুক্ত ছিলো।মেরামতের জন্য নৌযানগুলোকে ধোলাইখালের মাধ্যমেই ব্যাঙ্কশালে আনা হতো।

মিরপুরঃ

মিরপুর এলাকায় একসময় বাস করতেন সম্ভ্রান্ত ও বিখ্যাত মীর সাহেব।তার নামানুসারেই এলাকাটির নামকরণ করা হয়েছে মিরপুর।

তবে এলাকাটিতে যে নৌবন্দরটি রয়েছে মুঘল আমলে তা শাহ বন্দর নামে পরিচিত ছিলো।পাক আমলে এটি অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকা ছিলো।

মিরপুরই মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন ছিলো যা ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মুক্ত করা হয়।

ফার্মগেটঃ

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ের জন্য ফার্মগেট একটি পরিচিত এলাকা।এ এলাকার নামকরণের ইতিহাসও বেশ অদ্ভুত।

ব্রিটিশ সরকার বাংলার কৃষির উন্নয়ন,গবেষণা ও পশুপালনের জন্য ঐ এলাকায় একটি কৃষি ইন্সটিটিউট গড়ে তুলেছিলো,যা বর্তমানে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত ও তৎকালীন এই ইন্সটিটিউটের পাশে বিশাল এক ফার্ম বা খামার গড়ে তুলেছিল।সুবিশাল সেই ফার্মের প্রধান গেটটিই আজ ফার্মগেট এলাকা নামে পরিচিত।

মোহাম্মদপুরঃ

এলাকাটির নামকরণ করা হয়েছে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর নামানুসারে।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় অনেক অবাঙালি মুসলিন উদ্বাস্তু পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে এবং একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বাস করতে শুরু করে।বর্তমানে সেই এলাকাটিই মোহাম্মদপুর নামে পরিচিত।

খিলগাঁওঃ

খিলগাঁও নামকরণের পেছনে যতটা না ইতিহাস আছে,তার থেকে বেশী আছে কিংবদন্তী।

ইতিহাস অনুযায়ী প্রাচীনকালে খিলগাঁও,মাদারটেক,বাসাবোর পাশ দিয়ে প্রবাহিত হতো পান্ডুনদী।সেই নদীর তীরেই পত্তন হয়েছিলো “কুলগাও” নামের একটি গ্রামের।

ধারনা করা হয় সেই কুলগাও থেকেই বর্তমান “খিঁলগাও” নামের উৎপত্তি।

ইন্দিরা রোডঃ

১৯৩০ সালের দিকে এলাকাটিতে বাস করতেন দ্বিজদাস বাবু নামক একজন বিত্তশালী ব্যক্তি।আর তার বাড়ির পাশ দিয়েই তিনি নির্মাণ করেন একটি বড় সড়ক।

কিন্তু দুঃখের বিষয় দ্বিজলাল বাবুর বড়মেয়ে ইন্দিরা অকালে মারা যায়।পরবর্তীতে তার মেয়ের নামানুসারে তিনি রাস্তাটির নামকরণ করেন ইন্দিরা রোড,যেটি আজও লোকমুখে প্রচলিত।

গোপীবাগঃ

এলাকাটিতে একসময় ধর্ণাঢ্য ব্যবসায়ী গোপীবাবু বাস করতেন।তিনি নিজ খরচে এলাকাটিতে “গোপীনাথ জিউর মন্দির” প্রতিষ্ঠা করেন।পরবর্তীতে তার নামানুসারেই এলাকার নামকরণ করা হয় গোপীবাগ।তবে এলাকাটিতে কোনো বাগান ছিলো কিনা তা জানা যায়নি।

জিগাতলাঃ

সুবা বাংলার রাজধানী যখন ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাওয়া হয় তখন কিছু সময়ের জন্য ঢাকার জনবসতি কমতির দিকে ছিলো।অনেক মানুষ তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঢাকা,ত্যাগ করতে থাকে,বিশেষত বিদেশী পেশাজীবীরা।

ফলে ঢাকা পরিণত হয় এক পরিত্যাক্ত নগরীতে।জায়গায় জায়গায় জন্ম নেয় বুনোগাছ-জঙ্গল।একই পরিণতি হয়েছিলো ধানমন্ডিতেও।

এলাকাটিতে “জিকা/জিগা” নামক এক বিশেষ বুনোগাছের আধিক্য দেখা দেয়।কিছু মানুষ সেই জিগা গাছ পরিষ্কার করে বাস করতে শুরু করে।অনেকে জিগা গাছকে বাড়ির চারপাশের দেয়াল হিসেবেও ব্যবহার করতে থাকে।

জিগা গাছের তলায় গড়ে ওঠা সেই এলাকাটিই এখন জিগাতলা নামে পরিচিত।

বকশিবাজারঃ

মুঘল আমলে যেসব রাজকর্মচারী বেতন বন্টনের কাজে নিয়োজিত ছিলো তাদেরকে বকশি নামে অভিহিত করা হতো।

মুঘল শাসকেরা বকশিদের বসবাসের জন্য একটি সরকারি বাসস্থান করে দেয়।তার পাশে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি বাজার।সেই এলাকাটিই আজ বকশিবাজার নামে পরিচিত।

সুত্রাপুরঃ

কাঠের কাজ যারা করে তারা সুত্রধর নামে পরিচিত।একসময় এই এলাকাটিতে অনেক সুত্রধর পরিবারের বাস ছিলো।যার দরুন এলাকাটির,নামকরণ করা হয় সুত্রাপুর।

স্বামীবাগঃ

স্বামীবাগ এলাাকয় বাস করতো ত্রিপুরালিঙ্গ স্বামী নামের একজন ধনী ও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ।এলাকার সবার কাছে তিনি স্বামীজী নামেই সর্বাধিক পরিচিত ছিলো।তার নামানুসারে এলাকাটির নামকরণ করা হয় স্বামীবাগ।তবে এলাকায় কোনো বাগান ছিলো কিনা তা ইতিহাসবিদরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারিনি।

চাঁদনীঘাটঃ

সুবাদার ইসলাম খানের একটি বিলাসবহুল প্রমোদতরী ছিলো,যেটির নাম ছিলো “চাঁদনী”।প্রমোদতরীটি বুড়িগঙ্গা নদীর যে ঘাটে বাঁধা থাকতো,সেই ঘাটটিই “চাঁদনীঘাট” নামে পরিচিত ছিলো।এখন এর,আশেপাশের পুরো এলাকাটিই চাঁদনীঘাট নামে পরিচিত।

তোপখানাঃ

বর্তমানে তোপখানা এলাকায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গোলন্দাজ বাহিনীর একটি শক্ত ঘাঁটি ছিলো।ঘাটিটিতে অসংখ্য তোপ বা কামানের উপস্থিতি ছিলো।
তোপ বা কামানের ঘাটির সেই রোডটিই বর্তমানে তোপখানা রোড নামে পরিচিত।

নারিন্দাঃ

নারিন্দা এলাাকার পূর্বনাব ছিলো “নারায়ণদিয়া বা নারায়ণদি”।নারায়ণদিয়া মানে নারায়ণ দ্বীপ।
এলাকাটির চারপাশে নিম্নাঞ্চল থাকায় বর্ষাকালে এটি একটি দ্বীপের মতো দেখাতো।

যেহেতু এলাকাটি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা ছিলো,সেহেতু হিন্দুদের দেবতা নারায়ণের নামানুসারে এলাকাটির নামকরণ করা হয় নারায়ণ দ্বীপ।কালক্রমে সেটিই নারিন্দা নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

যাত্রাবাড়িঃ

আজকের যাত্রাবাড়ি একটা সময় ছিলো নিভৃত পল্লী।যাত্রাবাড়িসহ বিশাল একটি এলাকা ব্রাহ্মণচিরণ নামে পরিচিত ছিলো।এলাকাটির একটি বাড়িতে নিয়মিত যাত্রাপালা হতো,যার কারণে সেটি যাত্রানাড়ি নামে পরিচিত ছিলো।সেই থেকে এলাকাটি যাত্রাবাড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে।

নীলক্ষেতঃ

ব্রিটিশরা এদেশে আসার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে নীলচাষ শুরু করে।সেসময় ঢাকার বর্তমান নীলক্ষেতের বিশাল এলাকাজুড়ে নীলের চাষ হতো।এখন নীলের চাষ না হলেও লোকমুখে এখনও এলাকাটি নীলক্ষেত নামেই পরিচিত।

মতিঝিলঃ

মতিঝিল এলাকাটি মোগল আমল থেকেই একটি প্রসিদ্ধ এলাকা হিসেবে পরিচিত।
মতিঝিল একসময় মীর্জা মোহাম্মদের মহলের জন্য সুপরিচিত ছিলো।মহলের মধ্যে ছিলো একটি পুকুর।যেটি “মোতির ঝিল” নামে পরিচিত ছিলে।এই ঝিলটির জন্যই এলাকাটিকে মতিঝিল নামকরণ করা হয়।

মহাখালীঃ

একটা সময় মহাখালী এলাকায় বিরাট আয়োজন করে হিন্দুদের মহাকালী দেবীর পূজা করা হতো।যেটি মহাকালী পূজা নামে পরিচিত ছিলো।কালক্রমে সেই মহাকালী থেকে এলাকাটি মহাখালী নামে পরিচিত হয়।

পল্টনঃ

ইংরেজ আমলে এলাকাটিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি সেনানিবাস ছিলো,যেখানে এক প্লাটুন সৈন্য মোতায়েন করা ছিলো।সেই প্লাটুন থেকেই নাম বিকৃত হতে হতে বর্তমানে এলাকাটি পল্টন নামে পরিচিত হয়েছে।পরবর্তীতে আগাখানিরা এলাকাটিকে দুইভাগে ভাগ করে।

নয়াপল্টন ছিলো আবাসিক এলাকা,আর পুরোনো পল্টন বানিজ্যিক এলাকা।

টিকাটুলিঃ

প্রাচীনকালে বাংলায় ব্যপক হুক্কার প্রচলন ছিলো।হুক্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো টিক্কা।হুক্কাতে তামাক সাজানোর পর আগুন দিতে এই টিক্কা ব্যবহৃত হতে।
এই টিক্কা প্রস্তুতকারীরা যে নির্দিষ্ট এলাকায় বাস করতো,সেই এলাকাটিই বর্তমানে টিকাটুলি নামে পরিচিত।

গুলিস্তানঃ

গুলিস্তান নামটি বললে যে কেউ এক নামে চিনবে।অথচ ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের হোল্ডিংয়ের তালিকায় গুলিস্তান নামের কোনো জায়গায় নাম নেই। বরং এ এলাকাটির কেতাবী নাম বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ।

তাহলে গুলিস্তান নামটি কিভাবে আসলো?

আদতে গুলিস্তান ছিল একটি সিনেমাহলের নাম।এই সিনেমাহলটি ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের উত্তরে, ঢাকা জেলা ক্রীড়া মিলনায়তন এবং পল্টন মাঠের পাশে ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়।

আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশের নির্বিষ ও অবিষধর সাপ কোনগুলো??

কলকাতার বিখ্যাত ব্যবসায়ী ছিলেন খান বাহাদুর ফজল আহমেদ দোশানি।তিনি ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ঢাকায় চলে আসেন। তাঁর হাত ধরেই পরবর্তীতে এই প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করা হয়।

দেশের প্রথম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই হলটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে মানুষজন এই হলের নামেই এলাকাকে ডাকতে থাকে।

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলে পরিবর্তিত অবস্থায় দোশানি পাকিস্তানে চলে যান। ফলে গুলিস্তান সিনেমা হল পরিণত হয় পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে,যা পরবর্তীতে দেওয়া হয় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে।

গুলশানঃ

এলাকাটির পূর্বনাম ছিলো ভোলাগ্রাম,যা ছিলো একটি অনুন্নত এলাকা।১৯৬১ সালে এলাকাটিতে একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন তৎকালীন ডিআইটি(ঢাকা ইম্প্রুভ ট্রাস্ট)র প্রথম চেয়ারম্যান পাকিস্তানী আমলা জিএ মাদানী।

পশ্চিম পাকিস্তানের করাচির একটি অভিজাত এলাকা ছিলো গুলশান।মাদানী সেই এলাকার নামানুসারেই ভোলাগ্রামের নামকরণও করেন গুলশান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top